২২ বছর ধরে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালান মো. মোশারেফ হোসেন। রাত-বিরাতে কত হাজার হাজার মুমূর্ষু রোগী যে হাসপাতালে আনা-নেয়া করেছেন তার ইয়াত্তা নেই।
Advertisement
‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ থাকা রোগীদের চিকিৎসা সেবার দুয়ারে পৌঁছে দিতে প্রতিদিনের এই চাকরি কেমন লাগে? প্রশ্ন করতে তেমন ভাবাবেগের উদয় হয় না মোশারেফের।
তিনি বলেন, চাকরির প্রথম প্রথম এসব নিয়ে ভাবতাম, মনে নাড়া দিত। এখন আর কিছু মনে হয় না। এখন ভাবি, এই রোগী আনা-নেয়াই আমার চাকরি। জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে।
হাজার হাজার রোগী তো আনা-নেয়া করেছেন, আনার পথে রোগী মারা গেলে কেমন লাগে? এমন প্রশ্ন করতেই যেন চোখ ছলছল করে ওঠে মোশারেফের। ভেজাগলায় বলেন, যদি বছরে ৫০০ কিংবা ১ হাজার রোগী আনা নেয়া করে থাকি তাহলে ২২ বছরে ১৫/২০ হাজারের বেশি রোগী আনা-নেয়া করেছি।
Advertisement
এর মধ্যে এক থেকে দুইশ রোগী আনার পথে বা অ্যাম্বুলেন্সে মারা গেছে। খুব কাছেই এমন মৃত্যু দেখলে মনটা নরম হয়ে যায়। স্বজনরা আহাজারি করে। মনে হয়, আরেকটু আগে আসতে পারলে রোগীকে ডাক্তারের কাছে পৌঁছাতে পারতাম! হয়তো রোগী মরতো না বেঁচে যেতো।
চোখের সামনে কোনো মৃত্যুর ঘটনা মনে পড়ে কিনা, জানতে চাইলে ফিরে যান অতীতে। বলেন, দুই বছর আগের ঘটনা। আমাদের হাসপাতালের সাবেক সুপার স্যার (তত্ত্বাবধায়ক ডা. হাসান আল মামুন) ইজিবাইকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
কিন্তু অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। ঢাকায় নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে যশোর বিমানবন্দরে নিয়ে যাই। আর ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারও চলে আসে বিমানবন্দরে।
মামুন স্যারকে বিমান বন্দরে নামানোর পর সেখানেই মারা যান। স্যারের মৃত্যুর পর সেখানে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। স্যার অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।
Advertisement
মোশারেফ হোসেন যশোর সদর উপজেলার সানতলা গ্রামের মৃত আব্দুল জলিলের ছেলে। ১৯৮৩ সাল থেকে স্বাস্থ্যবিভাগের গাড়ি চালান। ১৯৯৬ সাল থেকে রয়েছেন যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে।
কোনো ঘটনা আজো নাড়া দেয়- এমন বিশেষ কিছু মনে পড়ে কিনা জানতে চাইলে বেশকিছু সময় চুপ করে থাকেন মোশারেফ। তারপর বলেন, কত রোগী আনা নেয়া করেছি, কত মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরে গেছে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারদের কথা আর কে মনে রাখে বলেন! তবে কোনো কোনো রোগী বা স্বজনরা দেখা হলে ভালো-মন্দ জানতে চায়। কথা বলে এতে অনেক আনন্দ পাই।
তবে বছর দশেক আগের একটি ঘটনা আজও মনে আছে বলে মোশারেফ ফিরে যান অতীতে। বলতে থাকেন, অনেক আগে ডা. হাজেরা শিরিন হক নামে গাইনি বিভাগের একজন ম্যাডাম ছিলেন যশোর হাসপাতালে। তিনি আমাকে অনেক ভালো চোখে দেখতেন-স্নেহ করতেন। পরে এখান থেকে বদলি হয়ে যান।
কিছুদিন পর ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের এক মহিলা যশোর হাসপাতালে ভর্তি হন। তার অবস্থা জটিল হওয়ায় তাকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। ওই মহিলাকে আমি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই।
রাতে পৌঁছে গাইনি বিভাগে গিয়ে দেখি নেমপ্লেটে ‘ডা. হাজেরা শিরিন হক’র নাম লেখা রয়েছে। তিনি ওই বিভাগের প্রধান। ম্যাডামের কথা মনে পড়ে যায়। তাই কালীগঞ্জের রোগীটির ব্যাপারে ছোট্ট একটা চিঠি লিখে ম্যাডারের অফিসে রেখে চলে আসি।
এর ১৫/২০ দিন পর ওই রোগীর লোকজন আমার সঙ্গে দেখা করে খুব আদর-আপ্যায়ন করে। তারা জানান, ওই ম্যাডাম তাদের রোগীর খুব যত্ন করে চিকিৎসা দিয়েছেন। এখন তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি এসেছেন। ওই রোগীর নাম ঠিকানা মনে নেই। কিন্তু তাদের আন্তরিকতা আজও মনে পড়ে।
মিলন রহমান/এএম/আরআইপি