জাগো জবস

টেন মিনিট স্কুলের সফলতার অংশীদার শিক্ষার্থীরা : আয়মান সাদিক

আয়মান সাদিক একজন শিক্ষা উদ্যোক্তা। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন টেন মিনিট স্কুল। এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান; যা অনলাইনে শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য এবং সহযোগিতা বিনামূল্যে দিয়ে থাকে। টেন মিনিট স্কুল পৌঁছে গেছে প্রায় দুই হাজার স্কুলে। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এসব বিষয় নিয়ে আয়মান সাদিকের সঙ্গে কথা বলেছেন কর্পোরেট আস্কের প্রতিষ্ঠাতা নিয়াজ আহমেদ-

Advertisement

জাগো নিউজ : টেন মিনিট স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কী কী চ্যলেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন?আয়মান সাদিক : বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই টেন মিনিট স্কুলের ভাবনা মাথায় এসেছিল। বিভিন্ন ওয়েবসাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তখন থেকেই যোগাযোগ চলতে থাকে এবং একটি কোম্পানিকে আমরা টেন মিনিট স্কুলের নির্মাণ বাবদ অগ্রীম ৫০ হাজার টাকাও দেই। দীর্ঘ ৬ মাস চেষ্টার পর যখন কোনো ফলাফল পাওয়া গেল না তখন কিছুটা মন ভেঙে যায়। কিন্তু দমে যাইনি, আবার নতুন করে ওয়েব নির্মাতা কোম্পানির সন্ধান শুরু করি। এবার পুরো টাকা অগ্রীম না দিয়ে অর্ধেকে কাজ শুরু হলো। পর্যায়ক্রমে ওয়েব নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পেছনে প্রায় দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। এভাবে দেড় বছর পার হয়ে গেল। ‘আরেকটা বার চেষ্টা করে দেখি, স্বপ্নটা সত্যি হয় নাকি’ চিন্তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছোট ভাইয়ের সাথে আবার ওয়েবসাইট নির্মাণের কাজ শুরু করি। প্রতিমুহূর্তে একটু একটু করে তৈরি হচ্ছিল টেন মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইট। ২০১৫ সালের ১০ মে ওয়েবসাইট লঞ্চ করার দিন নির্ধারণ করি, কিন্তু হঠাৎ লঞ্চিংয়ের ঠিক সাত দিন আগে আমাদের সব কোডিংগুলো কিভাবে যেন মুছে যায় এবং ওয়েবসাইটটি তার কার্যক্ষমতা হারায়। এরমধ্যে আমি ব্রুনেইতে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন শীর্ষক একটি সেমিনারে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার সুযোগ পাই। ব্রুনেইতে যখন সবার সামনে টেন মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইট দেখাবো এরকম একটি উত্তেজনা কাজ করছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের ওয়েবসাইট আর কাজ করছিল না। ১৭ মে আবার লঞ্চিংয়ের দিন নির্ধারণ করে সাত দিনের মাথায় আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করে পুনরায় টেন মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইটটি দাঁড় করাই। টেন মিনিট স্কুল ১৭ মে লঞ্চ হয় এবং লঞ্চিংয়ের কার্যক্রম শেষ করে ওইদিনই আমি ব্রুনেইয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। আমি যখন ট্রাঞ্জিশনের জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম, তখন জানতে পারলাম আমাদের সার্ভার ক্র্যাশ করেছে। অথচ ঘণ্টাখানেক পরই আমাকে টেন মিনিট স্কুলকে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে পুরো বিশ্বের সামনে। তখন আমার ক্রেডিট কার্ড ছিল না। এয়ারপোর্টে বসে এক বড় ভাইয়ের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নতুন সার্ভার কেনা হলো এবং সারা রাত কাজ করার পর সকালবেলা আবার টেন মিনিট স্কুল চালু হলো। আমি ও ব্রুনেইতে গিয়ে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে আসলাম টেন মিনিট স্কুল। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের সার্ভার আর ডাউন হয়নি।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আপনার কোনো স্বপ্ন আছে কি?আয়মান সাদিক : আমরা অনেকে না জেনে না বুঝে মুখস্ত করি। আমি এমন শিক্ষা ব্যবস্থা স্বপ্ন দেখি, যেখানে সবাই বুঝে বুঝে পড়বে। পড়াশোনাটা কোনো ভীতি নয়, আনন্দের সঙ্গে হবে। আমি এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি; যেখানে সবাই সিলেবাসের বাইরেও নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী হবে। আমি এমন শিক্ষা ব্যবস্থা স্বপ্ন দেখি- যেখানে একজন ছাত্রকে সিজিপিএ নয় বরং মেধা দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে। সবাই নিজেদের পছন্দের মতো বিষয় পড়বে, শিখবে।

জাগো নিউজ : টেন মিনিট স্কুলের বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে বলবেন কি?আয়মান সাদিক : প্রতিদিন প্রায় ২ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী টেন মিনিট স্কুলের মাধ্যমে পড়াশোনা করছে। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রতিটি চ্যাপ্টারের ওপর মোট সাড়ে ৬ হাজারের উপরে ভিডিও রয়েছে। ২১টি প্রফেশনাল কোর্স রয়েছে টেন মিনিট স্কুলের সাইটে। মাইক্রোসফট অফিস এবং এডবির প্রতিটি সফটওয়্যারের উপরে সম্পূর্ণ কোর্স রয়েছে। ২১৭টি স্মার্ট বুক ও ৩৫০টির বেশি ব্লগ রয়েছে। ৪৮ হাজারের বেশি কুইজ আপলোড করা আছে। লাইভ ক্লাস আছে ৩৫টিরও বেশি। ইউটিউবে আছে ২ লাখের বেশি সাবস্ক্রাইবার। ফেসবুকে লক্ষাধিক মেম্বরের কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিয়ে থাকি। ৫৩ জন নিবেদিত প্রাণ টিম মেম্বর এবং ৬০ জনের বেশি শিক্ষকের নিরলস পরিশ্রমের ফল আজকের এই টেন মিনিট স্কুল।

Advertisement

জাগো নিউজ : আপনার প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির তালিকাটি কেমন হতে পারে?আয়মান সাদিক : ২০১৮ সালে আমরা পেলাম কুইন্স ইয়াং লিডার অ্যাওয়ার্ড। এছাড়া ২০১৬ সালে লন্ডনে ফিউচার লিডারস লিগ চ্যম্পিয়ান অ্যাওয়ার্ড পাই। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য টেন মিনিট স্কুল ‘সুইস অ্যামবাসি অ্যাওয়ার্ড’, ‘গ্লোমো অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত হয়। আমরা পেয়েছি এপিক্টা অ্যাওয়ার্ড, যাকে আইসিটির অস্কার বলা হয়। আর জাতীয় পর্যায়ে আইসিটি পুরস্কার, ইয়োরথ অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও অর্ধশতাধিক সম্মাননা পেয়েছি।

এবারে অন্য প্রসঙ্গে বলি, টেন মিনিট স্কুলের শুরুর দিকে আমরা সারা রাত জেগে একটি স্টুডিওতে ভিডিও বানাতাম। গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর প্রতিবেশিরা মাকে জিজ্ঞাসা করতো- ‘ভাবি, আয়মান কী করে?’ আমার মা উত্তর দিতো- ‘সে তো ভিডিও বানায়।’ তারা বলতেন, ‘ভাবি, কিসের ভিডিও বানায়?’ মা বলতেন, ‘তা তো জানি না।’ প্রতিবেশিরা দেখতো, আমি প্রতিদিন রাতে ভিডিও বানানোর জন্য যাই আর সকালে ফিরি। এতে তাদের মনে নেতিবাচক প্রশ্নের জন্ম হতো। আমার মা প্রথমদিকে এর জন্য কিছুটা কষ্ট পেতেন।

প্রথমদিকে আমি যখন বিভিন্ন ইভেন্টে বক্তা হিসেবে যেতাম, আমি টেন মিনিট স্কুলের টি-শার্ট পরতাম। একবার একটি ইভেন্টে কথা বলতে যাই এবং সেখানকার দারোয়ান আমাকে আটকে দেয়। তাকে জানালাম, আমি এই সেমিনারের বক্তা। সে মিনমিনিয়ে বলল, এই ছোকড়া বক্তা হয় কিভাবে? এরপর সে আয়োজককে ফোন দিয়ে জানায়, এক পোলা তাকে এসে বলছে; সে নাকি স্পিকার। এরকম স্পিকার থেকে ছোকড়া আর ছোকড়া থেকে পোলা আবার পোলা থেকে স্পিকার, এই ঘটনাগুলোর কথা ভাবলে এখন হাসিই পায়।

জাগো নিউজ : আপনার কাছে সফলতার মানে কী?আয়মান সাদিক : সফলতার মানে হচ্ছে প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা, মানুষকে নতুন কিছু শেখানো। মানুষকে হাসানো এবং মানুষের জীবনে মূল্য সংযোজন করা।

Advertisement

জাগো নিউজ : টেন মিনিট স্কুলের সফলতার প্রধান তিনটি কারণ?আয়মান সাদিক : আমাদের চারপাশে প্রায়ই দেখি, কেউ নতুন কিছু করতে চাইলে সবাই তার বিরোধিতা করে এবং সে যাতে বেশি দূর এগোতে না পারে সেজন্য সবাই পেছন থেকে আকড়ে ধরে। আমার ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। আমি যখনই যাকে যা অনুরোধ করেছি, তার কাছ থেকে তা-ই পেয়েছি। মানুষের মাঝে বিশ্বাস দেখতে পাই। সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় আমাকে বিশ্বাস করেছে, রবি আমাকে বিশ্বাস করেছে। আমার টিম মেম্বররা আমাকে বিশ্বাস করেছে। টেন মিনিট স্কুল বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যা শুধুমাত্র বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা চালাচ্ছে। টেন মিনিট স্কুলের সফলতার সবচেয়ে বড় অংশীদার হচ্ছে এর শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের যখন যেটা করার জন্য অনুরোধ করেছি; তখন তারা সেটাই করেছে।

জাগো নিউজ : দেশে এতো বেকার কেন?আয়মান সাদিক : শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও ডিজিটাল হচ্ছে। আগামীতে আরো উন্নত ও সহজতর হবে। এখন পর্যন্ত দেশে এক লাখ সত্তর হাজার স্কুল আছে। আমরা পৌঁছেছি ২ হাজার স্কুলে। দেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ আর আমরা পড়াই ২ লাখ শিক্ষার্থীকে। সুতরাং এখনও অনেক কাজ বাকি। এই মুহূর্তে একুশ শতাব্দির দক্ষতাগুলো নিয়ে নতুন কোর্স এবং কন্টেন্ট সাজানোর কাজ চলছে। এই কাজ সম্পূর্ণ হলে তা বেকার সমস্যা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

জাগো নিউজ : তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতি উন্নয়নে টেন মিনিট স্কুলের কোনো পদক্ষেপ আছে কি?আয়মান সাদিক : আমরা খুব শিগগিরই শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ অনলাইনে আনছি। কিভাবে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্ট দিয়ে পাঠদান করা সম্ভব, তা নিয়ে সরকারেরও বড় পরিকল্পনা আছে। সর্বোপরি আমাদের টেন মিনিট স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি সহায়ক। আর এ সহায়তা যে কেউ পেতে পারে, তা আবার একদম ফ্রি।

এসইউ/জেআইএম