ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
Advertisement
ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতাসহ অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমছে। জবাবদিহিতা আর সুশাসন না থাকায় রাষ্ট্রের আর্থিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। দুই পর্বের প্রথমটি থাকছে আজ। জাগো নিউজ : ব্যাংকিং খাতকে এতিম ও বিকলাঙ্গ বলছে সিপিডি। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
মির্জা আজিজুল ইসলাম : কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে একেকজন একেক রকম বিশেষণ ব্যবহার করতেই পারেন। আমি মনে করি, ব্যাংকিং খাতকে একেবারে এতিম বা বিকলাঙ্গ বলাটা মনে হয় কিছুটা অতিরঞ্জিত।
Advertisement
তবে ব্যাংকিং খাত নিঃসন্দেহে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
জাগো নিউজ : উদ্বেগের কারণগুলো যদি ব্যাখ্যা করতেন?
মির্জা আজিজুল ইসলাম : ব্যাংকিং খাতে শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকায়। অবলোপনকৃত ঋণ বাদ দিয়েই এ হিসাব। ২০১২ সালে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা।
আবার ব্যাংক কেলেঙ্কারির বিষয়গুলো তো উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ, হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক এবং সর্বশেষ ফারর্মাস ব্যাংকের কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে জনসাধারণের আস্থা কিছুটা কমে যাচ্ছে।
Advertisement
জাগো নিউজ : ‘কিছুটা’ বলছেন কেন? অনেকেই তো এসব কেলেঙ্কারিকে ‘ভয়াবহ’ বলছেন।
মির্জা আজিজুল ইসলাম : আস্থার প্রসঙ্গে বলছি। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। এজন্য আরেক কারণ হচ্ছে, ব্যাংকের দেয়া সুদের হারের চাইতে বর্তমান মূল্যস্ফীতি বেশি। ব্যাংকে আমানত রেখে কেউ প্রকৃতপক্ষে লাভবান হতে পারছেন না।
জাগো নিউজ : সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও তো ব্যাংকের আমানতের ওপর প্রভাব ফেলছে…
মির্জা আজিজুল ইসলাম : হ্যাঁ। ব্যাংক আমানতের সুদের চেয়ে সরকারের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। এ কারণে সঞ্চয়পত্রের চাহিদা বাড়ছে। বাজেটে সরকার যে টার্গেট নিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। চলতি অর্থবছরের আরও কয়েক মাস বাকি। গত অর্থবছরেও টার্গেটের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি বিক্রি হয়েছিল। এ কারণে ব্যাংকিং খাত যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্র নিজেই ব্যাংক-বৈষম্য দাঁড় করিয়েছে।
জাগো নিউজ : বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে। এটি কতটুকু উদ্বেগের?
মির্জা আজিজুল ইসলাম : বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগের। গত বছর থেকে প্রতি মাসে ঋণের প্রবাহ বেড়ে চলছে। আগের বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টার্গেট দেয়া ছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। আগ্রাসী এ নীতির কারণে অযোগ্যরা ঋণ পেয়ে যাচ্ছে। ঋণগুলো পরবর্তীতে শ্রেণিকৃত ঋণে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এ সমস্যাগুলোই উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জাগো নিউজ : এই প্রশ্নে সুশাসনকে কতটুকু গুরুত্ব দেবেন?
মির্জা আজিজুল ইসলাম : ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব অনেক আগে থেকে। এখন এটি আরও বেড়েছে। যেমন- আগে একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে দুজন থাকতে পারতেন। এখন চারজন থাকতে পারছেন। পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ ছয় বছর থেকে বাড়িয়ে নয় বছর করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তগুলো ব্যাংকিং খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। এ খাতে জবাবদিহিতা দিন দিন কমে আসছে। এসব কারণেই তা হচ্ছে।
আবার ব্যাংক মালিকদের চাপের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলোও এ সেক্টরের উন্নয়নে অন্তরায়। যেমন- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণের সুদের হার কমিয়ে দেয়া। এসবের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
জাগো নিউজ : ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট নিরসনে সুদের হার কমানোর দাবি ছিল…
মির্জা আজিজুল ইসলাম : তারল্য সংকট নিয়ে ব্যাংকগুলোর যে দাবি, তা সঠিক নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোতে অতি তারল্য রয়েছে। হয়তো দু-একটি ব্যাংকের কথা আলাদা হতে পারে।
জাগো নিউজ : রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে লাভের যে অংশ সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাখা হতো, সেখান থেকেও তো বেসরকারি ব্যাংকগুলো অধিক মাত্রায় ঋণ নিতে পারছে। এটিও তো সংকটের অন্যতম কারণ…
মির্জা আজিজুল ইসলাম : সরকার রাজস্ব আয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে মুনাফা এনে ব্যাংকে রাখে। আগে এ অর্থের শতকরা ২৫ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিতে পারত। এখন তা বাড়িয়ে ৫০ ভাগ করা হয়েছে এবং তারল্য সংকটের কথা বলেই তা করা হয়েছে।
জাগো নিউজ : তাহলে কি বাংলাদেশ ব্যাংক নিষ্ক্রিয়-প্রায়?
মির্জা আজিজুল ইসলাম : কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ভূমিকা রাখতে পারছে না। আবার অনেক সিদ্ধান্তই সরকারের থাকে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছুই করার থাকে না। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জাগো নিউজ : এই ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে আমরা আসলে যাচ্ছি কোথায়?
মির্জা আজিজুল ইসলাম : মূলধনী বাজার বা শেয়ার মার্কেট থেকে যে বিনিয়োগের অর্থ আসার কথা, তা আসছে না। ব্যাংকিং খাত থেকেই মূলত বিনিয়োগের অর্থ আসে। এ কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব অনেক বেশি। চিন্তার বিষয় ঠিক এখানেই।
এএসএস/এমএআর/আরআইপি