দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শারীরিক ভাবে অসুস্থ। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। বিএনপি-নেতৃবৃন্দ এবং তার চিকিৎসকগণ এই দাবি করে আসছেন বেশ অনেকদিন ধরেই। বিএনপি’র একনিষ্ঠ সমর্থক ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বেগম জিয়াকে অসুস্থ প্রমাণ করতে গিয়ে যেভাবে তাকে ‘ওবিস’ বা স্থুল এবং বার বার তার জন্য মানসিক রোগের ডাক্তারের ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছেন তাতে মানুষ বেগম জিয়ার অসুস্থতা সম্পর্কে ভিন্ন মেসেজ পায়।
Advertisement
একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা এবং একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন সকল পক্ষ থেকেই সমান ভাবে জরুরি। কেন বেগম জিয়াকে মানসিক রোগের ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন? কিংবা কেন তাকে বার বার ‘ওবিস’ বলা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। শেষবার যখন বেগম জিয়া জনসম্মুখে আসেন, কারা কর্তৃপক্ষ যখন তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সামনে চেক আপের জন্য নিয়ে আসে তখন বেগম জিয়াকে দেখে কেউ যদি তাকে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া কিংবা ওবিস বলে মনে করে থাকেন, তাহলে তার বুদ্ধি-বিবেচনা ও অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে।
বেগম জিয়ার এই দৃঢ়চেতা মনোভাবই যে তাকে এতো বিশাল একটি সমর্থকগোষ্ঠীর নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেটা বলাই বাহুল্য কিন্তু কেন কতিপয় বিএনপি-সমর্থক বেগম জিয়াকে অসুস্থ, মানসিক রোগী বা ওবিস বা স্থুল বলে প্রচার করছেন সেটা তারাই ভালোই বলতে পারবেন। একথা সত্য যে, বেগম জিয়া এখন যে বয়সে রয়েছেন তাতে তার নিয়মিত সেবা-যত্ন এবং ডাক্তারী পরীক্ষা প্রয়োজন। তিনি সেটি করেন মূলতঃ বিদেশে গিয়েই। এর আগে সৌদিতে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছেন এবং গত বছর তিনি দেখিয়েছেন লন্ডনে। এদেশে তিনি কোনো ডাক্তার দেখিয়েছেন বলে অন্ততঃ প্রকাশ্য কোনো খবর জানা যায় না।
দুর্নীতির দায়ে সাজা প্রাপ্ত হয়ে জেলে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপি’র পক্ষ থেকে বার বার তার অসুস্থতা নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করে বেগম জিয়ার সুষ্ঠু চিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলছে। কিন্তু বিএনপি স্বাভাবিক ভাবেই কারা কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের এসব পদক্ষেপকে মেনে নিতে চাইছে না। তারা বেগম জিয়াকে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের দিয়ে পরীক্ষার দাবি জানিয়েছে, সরকার সে কারণেই বেগম জিয়ার দলীয় চিকিৎসকদের দিয়েই একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করেছিল।
Advertisement
তারা দেখেই যে রিপোর্ট দিয়েছে সে অনুযায়ী বেগম জিয়ার চিকিৎসা চলছে বলে কারা কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে একটি দাবি নিয়েই এখন মূলতঃ আলোচনা চলছে তাহলো, বেগম জিয়াকে ইউনাইটেড হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিএনপি নেতারা একটি বিশেষ এমআরআই করার দাবি জানিয়েছেন বেগম জিয়ার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, প্রয়োজনে সেটাও করা হবে, তবে তার আগে সরকারি ডাক্তারগণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন এবং জানাবেন যে, আদৌ সেটার প্রয়োজন আছে কিনা।
এখন প্রশ্ন হলো, কী আছে ইউনাইটেডে যা দেশের অন্য কোনো হাসপাতালে নেই? যে কোনো সাধারণ রোগীকেও যদি ইউনাইটেড কিংবা এ্যাপোলোর মতো হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাহলে এসব হাসপাতালের অনুমতি নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে দেশের অন্যান্য বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে।
এক্ষেত্রে বেগম জিয়াকে কারাবন্দী চিকিৎসারীতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হাসপাতালে রেখে কেন ইউনাইটেড থেকে ডাক্তার এনে পরীক্ষা করানো যাবে না? এসব প্রশ্ন গৌণ হয়ে যায়, বিএনপি ও সরকারের মধ্যে বেগম জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে চলমান দ্বন্দ্ব দেখে। যেনো ইউনাইটেডে নিলেই বেগম জিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন আর ইউনাইটেডে পাঠালে এমন কোনো ঘটনা ঘটবে যা সরকার সামলাতে পারবে না বেগম জিয়াকে ইউনাইটেডে পাঠানো নিয়ে দু’পক্ষের মূল দ্বন্দ্বটা বোধকরি এখানেই।
বেগম জিয়া দুর্নীতির দায়ে সাজা লাভের পর থেকেই তাকে ডিভিশন দেওয়া হলো না, তাকে এটা করা হয়নি, ওটা করা হয়নি ইত্যাদি বহু দাবি বিএনপি জানিয়ে এসেছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। একজন কারাবন্দী হিসেবে বেগম জিয়া যে বিশিষ্ট তা আমরা বুঝতে পারি যখন তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক একজন পরিচারিকা দেওয়া হয় জেলের ভেতর। তাকে আর কি কি দেওয়া হয়েছে আর কি কি দেওয়া হয়নি, সে বিষয়টি এরপর মোটামুটি এ কারণেই অবান্তর হয়ে যায় যে, কারাবন্দী হিসেবে বেগম জিয়া সত্যি সত্যিই বিশেষ মর্যাদা নিয়েই রয়েছেন। এমনকি জেলের ভেতর সকল নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার সুযোগও বেগম জিয়া পেয়েছেন। কোনো জেলের ইতিহাসে এরকম ঘটনা বিরল।
Advertisement
আমরা জানি বা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, জেলের ভেতর রাজনৈতিক নেতাদেরকে কোনো খবর দিতে হলে কতো অভিনব সব পন্থা অবলম্বন করা হতো, কখনও খাবারের ভেতর কাগজে লিখে, কখনও টিফিন ক্যারিয়ারের তলায় চিরকুট পাঠিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে খবর দেওয়া হতো। কিন্তু বেগম জিয়ার সঙ্গে দলীয় নেতৃত্ব বৈঠক করেছেন, পরিবারের সদস্যগণ একাধিকবার তার সঙ্গে দেখা করেছেন, ফলে বিএনপি নেতৃবৃন্দ যখন কোনো রকম পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে দেখা করতে জেলখানার গেটে গিয়ে দাঁড়ান তখন বিষয়টি হাস্যকর হয়ে ওঠে মানুষের সামনে।
অপরদিকে বেগম জিয়া এর আগেও একাধিকবার নিজেকে দলীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন, মাসের পর মাস তিনি দলীয় কার্যালয় থেকে নিচে নামেননি, কারো সঙ্গে দেখা করেছেন বলেও জানা যায়নি। ফলে কারা কর্তৃপক্ষ যখন দাবি করেন যে, বেগম জিয়া কারো সঙ্গে দেখা করতে চান না, তখন বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
মজার ব্যাপার হলো, বেগম জিয়াকে যারা পর্দানশীন মহিলা হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, সে ক্ষেত্রে জেলের ভেতর পরিবারের সদস্যদের বাইরে অন্য কোনো নেতাদের প্রবেশের ক্ষেত্রে বেগম জিয়ারও আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু প্রচারণার ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া বিষয়ে সকলেই ভুলে যায় যে, এর ভিন্ন পাঠও হতে পারে। একজন বিখ্যাত আইনজীবী টেলিভিশন-এর টক শো অনুষ্ঠানে সংযুক্ত হয়ে বেগম জিয়ার শোবার খাট, টয়লেট ইত্যাদি নিয়েও প্রশ্ন তুললেন। জেলখানা আর গুলশানের বাড়ির মধ্যে যে পার্থক্য থাকবেই সেটি ভুলে যাওয়াটা বোধ করি ঠিক হবে না। বরং বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে যে কঠিন পরীক্ষায় তিনি এখন পড়েছেন, হয়তো ইতিহাসে তিনি এই পরীক্ষার জন্যই সবচেয়ে আলোচিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন একদিন, কে জানে?
ফিরে আসি ইউনাইটেড হাসপাতাল প্রসঙ্গে। এই হাসপাতালটি এমন একটি জায়গায় প্রতিষ্ঠিত যেখানে মূলতঃ বিদেশি কূটনীতিকদের বসবাস। এখানে যারা চিকিৎসার জন্য যাওয়া-আসা করেন তারাও মূলতঃ বিদেশিই। আমরা দেখেছি বেগম জিয়াকে যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সেদিন কী অবস্থা হয়েছিল।
একদিকে বেগম জিয়া এই বয়সে অসুস্থতা নিয়ে এরকম ভিড়কে উপেক্ষা করতে পারছিলেন না, অন্যদিকে গরমে ও ভিড়ে তার আরো অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যে তৈরি হয় তা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝবেন না কারণ তাতে তাদের রাজনীতির খেলা বিঘ্নিত হয়। একদিনের জন্যও যদি বেগম জিয়াকে নাজিমুদ্দিন রোড থেকে ইউনাইটেডে আনা হয় তাহলে তার নতুন করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হওয়ার সুযোগ ছাড়াও সাধারণ মানুষ ও বিদেশি নাগরিকদের যারা ইউনাইটেডে চিকিৎসা নিতে আসবেন তাদের যে অবর্ণনীয় কষ্ট পোহাতে হবে সেটা বেগম জিয়া নিজেই জনগণের নেত্রী হয়ে পছন্দ করবেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাই যায়।
আরো ভয়ঙ্কর কথা হচ্ছে, আমাদের ভুললে চলবে না যে, এই এলাকাতেই হোলি আর্টিজানের মতো আতঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছিল। এই এলাকা এখনও শঙ্কামুক্ত বলে কেউ মনে করেন না। এখানে রয়েছে কড়া নজরদারি। এর মধ্যে বেগম জিয়াকে সেখানে নিয়ে আসায় যে ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন?
এই মুহূর্তে বিএনপি নেতৃবৃন্দ যে সব প্রশ্ন তুলে বেগম জিয়াকে ইউনাইটেডে চিকিৎসার ব্যবস্থা করাকে যৌক্তিক করতে চান তাহলো ১/১১-র আমলে শেখ হাসিনা বা আব্দুল জলিলকে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার ঘটনা। ১/১১-র সরকার ও তাদের গৃহীত কোনো পদক্ষেপকেই বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কেউই মানে না, তাই তাদের গ্রহণ করা এই চিকিৎসা-কাণ্ডকে কেন বিএনপি নেতৃত্ব বৈধ মনে করেন?
বার বার এই উদাহরণ দিলে মানুষ একথাই ভাববে যে, তাহলে ১/১১-র সরকারের বাকি সব কর্মকাণ্ডকেও বৈধতা দিতে অসুবিধে কিসে? সেটাতো বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কেউই করবে না, তাই না? সবচেয়ে বড় কথা হলো, বেগম জিয়া একজন দেশনেত্রী, তিনিই যদি সরকারি চিকিৎসার ওপর ভরসা করতে না পারেন, সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় ভরসার চিকিৎসালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসার ওপরই ভরসা না করেন তাহলে তিনি দেশনেত্রী হিসেবে নিজেকে জনগণের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
সরকার হয়তো চাপে পড়ে বেগম জিয়াকে ইউনাইটেডে চিকিৎসার জন্য পাঠালেও পাঠাতে পারে (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীতো বলেই দিয়েছেন, প্রয়োজনে সেখানেও পাঠানো হবে) কিন্তু তাতে জনগণের সামনে বেগম জিয়ার সম্মান বাড়ে না। তিন তিন বার যিনি একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনিই দেশের সাধারণ মানুষের জন্য যে চিকিৎসা সেটি নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, এটি কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
ঢাকা ২৩ এপ্রিল, সোমবার ২০১৮লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/এমএস