শহর-নগর, জেলা-উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনসাধারণের চিকিৎসার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের চিকিৎসার একমাত্র ভরসা এই হাসপাতাল।
Advertisement
রোগীরা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু এখানে সর্বত্রই চলছে দালালের দৌরাত্ম। দালালের কথা না শুনলে চিকিৎসা হয় না রোগীর। এমনকি তাদের কথা মতো না চললে রোগীর অপারেশন হয় না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী রোগী।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিতে গ্রাম থেকে এখানে আসলেও দালালদের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয় বলে মনে করেন রোগীরা।
ভুক্তভোগীরা আরও অভিযোগ করেন, এসব দালালদের পরিচয় করিয়ে দেয় নিজ নিজ বিভাগের দায়িত্বরত কিছু নার্স, আনসার সদস্য এমনকি চিকিৎসকরাও। তাই ভুক্তভোগীরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। এমনকি প্রতিবাদ করলেও প্রতিকার মেলে না। উল্টো লাঞ্ছিত হতে হয় তাদের কাছে।
Advertisement
সম্প্রতি জাগো নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব অভিযোগের চিত্র। জানা গেছে, বিভিন্ন ওয়ার্ড ও সিটিস্ক্যান, এমআর ও এক্সরেসহ যাবতীয় পরীক্ষা কক্ষের সামনে তথাকথিত বিভিন্ন শ্রেণির দালাল চক্রের সদস্যরা ঘোরাফেরা করতে থাকে। তাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে হাসপাতালের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দেয়। আবার কখনও কখনও বিভিন্ন চিকিৎসকদের সহকারী পরিচয় দিয়ে রোগীদের সঙ্গে মিশে তাদের সমস্যা সম্পর্কে জেনে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়। তাদের কথায় রোগীরা সরল মনে বিশ্বাস করে প্রতারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কাজী জালাল নামে এক ভুক্তভোগী রোগী জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা মেডিকেলে প্রায় ৩৮ হাজার টাকা খরচ করেছি। এক মাস কেবিন ভাড়া করে থেকেও শুধুমাত্র দালালের কথা না শোনায় আমার হাতের অপারেশনটা করানো হয়নি। দালালের কথা না শোনায় উল্টো আমাকে রিলিজ দিয়ে দিয়েছে। বলেছে এখানে আমার চিকিৎসা হবে না। এটা শুধুমাত্র দালালের কথা না শোনায়। দালাল থেকে ওষুধ না কেনায় চিকিৎসকরা আমার অপারেশনটা করেনি। এটা কেমন আচরণ?
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় হাতে ইনজুরি হলে চামড়ার ভেতরে পাত বসানো হয়। এখন হাত পুরোপুরি সুস্থ হওয়ায় তিনি ওই পাত বের করতে মাস খানেক আগে যাত্রাবাড়ীর স্থানীয় লাইফ লাইন নামে একটি হাসপাতালে অপারেশনের জন্য যান। সেখানে পরিচয় হয় ঢামেকের চিকিৎসক ডা. ফয়সাল এস্কান্দারের সঙ্গে।
জালাল প্রাইভেটে চিকিৎসা খরচ বহন করতে অক্ষম। পরে ওই চিকিৎসক তাকে অল্প খরচে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপারেশনটা করানোর পরামর্শ দেন। জালাল সে অনুযায়ী পরের দিন ঢামেকে আসলে চিকিৎসক তাকে ১১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করায়। এরপর জালাল হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয়ের মাধ্যমে অপারেশনের জন্য কেবিনে ভর্তি হন।
Advertisement
জালাল আরও বলেন, গত মার্চ মাসের ২২ তারিখে অপারেশন করানোর কথা বলে কেবিনে ভর্তির জন্য আমার কাছ থেকে লুৎফর নামে একজন ওয়ার্ড বয় মোট ৩ হাজার ৭০০ টাকা নিয়েছে। কিন্তু রশিদ দিয়েছে ১ হাজার ৭০০ টাকার। বাকি দুই হাজার টাকার হিসাব মেলেনি। এরপর ৩০ মার্চ অপারেশনের তারিখ দিলে ২৮ তারিখে আমার শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলা হয়।
কিন্তু পরীক্ষগুলো এখানে করানোর ব্যবস্থা না থাকায় বাহির থেকে করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ডাক্তার পরীক্ষাগুলোর প্রেসক্রিপশনটা আমার হাতে না দিয়ে বহিরাগত আলতাপ নামে একজনকে দিয়েছে। আলতাপ আমার অপারেশনের জন্য ১০টি মাস্ক, ১০টি টুপি, ২টি সুতা, ১টি স্ট্যাপলার, একটি পিনের বক্স ও ১টি হেক্সিসলের জন্য ১ হাজার ৮০০ টাকা নেয়।
কিন্তু এতগুলো কার জন্য কিনেছে বা এগুলো কোথায় রেখেছে তা জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার কিনতে বলেছে বলে আর কোনো কিছু বলেনি। এরপর বহিরাগত রফিক নামে অপর একজন বললো, অপারেশনের জন্য যন্ত্রপাতি ভাড়া বাবদ ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে। এ বিষয়ে কোনো স্লিপ আছে কি-না জানতে চাইলে জবাবে রফিক বলেন, আপনার অপারেশন হলেই তো হবে, স্লিপ দিয়ে কি করবেন।
ডাক্তার বলছে দেয়ার জন্য। ডাক্তারের কথা শুনে এই টাকাগুলোও দিলাম। কিন্তু ৩০ তারিখ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোনো অপারেশন হয়নি। কখন হবে কেউ জানে না। তাই চিন্তায় পড়লাম। কারণ প্রতিদিন কেবিন ভাড়া দিতে হচ্ছে সোয়া চারশ টাকা করে।
তিনি আরও বলেন, এরপর এপ্রিলের ২১ তারিখ আমার অপারেশনের তারিখ দেয়া হয়। কিন্তু ওই তারিখেও অপারেশনটা হয়নি। কারণ ডাক্তার বলেছিল অপারেশনের জন্য ১ ব্যাগ রক্ত ও ১টি টনিটেক লাগবে। এজন্য বহিরাগত রফিকুল আমার কাছে দুই হাজার টাকা দাবি করেছিল। অথচ বাজার মূল্য ৫শত টাকা। তাই বাহির থেকে এটি কিনেছিলাম টাকা বাঁচানোর জন্য। এ কারণে রফিকুল আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে হুমকি দিয়ে বলে আপনার অপারেশন কোন ডাক্তারে করে আমি দেখবো।
এরপর ২১ এপ্রিল সারাদিন অপেক্ষা করেও কোনো অপারেশনের ডাক পড়েনি জালালের। পরে জালাল বুঝতে পারে দালালের কথা না শুনে তার এ অবস্থা হয়েছে। এজন্য প্রতিকার চেয়ে জালাল ঢামেক পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিল। কিন্তু অভিযোগ দিয়ে অপারেশন হয়নি উল্টো তাকে এই হাসপাতাল থেকে ২২ এপ্রিল রিলিজ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জালাল।
শুধু জালাল নয় এমন অভিযোগ করেছেন ইমরান নামে ভুক্তভোগী এক রোগীর স্বজন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কিছুদিন আগে আমার মায়ের অপারেশনের জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পরও মায়ের অপারেশন হচ্ছিল না। পরে চিকিৎসকের সহকারীর কাছে অপারেশনের বিষয়ে জানতে চাইলে বলে, ২০ হাজার টাকা দিলে কালই তার অপারেশন হয়ে যাবে। এত টাকা আমি দিতে পারিনি। পরে মাকে নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে আরও অল্প খরচে অপারেশন করিয়েছি। কিন্তু কথা হলো টাকা দিলে কালই অপারেশন হবে আর না দিলে কবে হবে সেই সময়টাও কেউ বলতে পারে না এটা কেমন বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা?
এ বিষয়ে ঢামেকের অর্থপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. সামসুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগের ব্যাপারে শুনতে পায়নি। তবে সে যদি এমন অভিযোগ দিয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
তিনি বলেন, দালালকে যদি কোনো টাকা দিয়ে থাকে তাহলে ওই ব্যক্তিকে আমাদের কাছে ধরে আনলে পুলিশের হাতে তুলে দেব। হয়তো কারো সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। যাই হোক সে যদি আমার সঙ্গে দেখা করে তাহলে বিষয়টা বুঝতে পারবো। তবে তার অপারেশন হবে। হয়তো সময় মতো সে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই সেদিন তার অপারেশন হয়নি।
এসএইচ/এমআরএম/আরআইপি