বিশেষ প্রতিবেদন

অভিযোগ গঠনেই আটকা রানা প্লাজার মামলা

সাভারের রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছরেও হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা দুই মামলার কোনো কূলকিনারা হয়নি। প্রায় দুই বছর আগে ওই দুই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনের পর আইনি জটিলতার কারণে এখনও কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়নি।

Advertisement

রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করছে, প্রত্যেক ধার্য তারিখে সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেন। কিন্তু কিছু আসামি ‘বৈধতা চ্যালেঞ্জ’ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ায় সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে না। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মতে, ‘তারা ন্যায় বিচারের স্বার্থে উচ্চ আদালতে গেছেন।’

হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খোন্দকার আব্দুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতি ধার্য তারিখে হত্যা মামলার সাক্ষ্য দিতে সাক্ষীরা আদালতে হাজির হন। কিন্তু মামলাটির কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় আইনি জটিলতায় আমরা সাক্ষ্য নিতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, রানা প্লাজার শ্রমিক হত্যা মামলাটির অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আট আসামি রিট করেন হাইকোর্টে। তাদের মধ্যে সাতজনের পক্ষে স্থগিতাদেশ শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলীর স্থগিতের আদেশ। ১২ মে সেটি শেষ হবে। ১৬ মে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। সেদিন আশা করছি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।

Advertisement

ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনারুল কবির বাবুল বলেন, কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করেন। রিভিশন মামলাটির আদেশ না পাওয়ায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজার হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় প্রায় দুই বছর আগে অভিযোগ গঠন হয়েছে। কিছু আসামি উচ্চ আদালতে মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। তাদের পক্ষে স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, মামলার প্রধান আসামি রানা ছাড়া সবাই জামিনে রয়েছেন। আমরা চাই মামলাগুলো যেন দ্রুত শেষ হয়। ন্যায়-অন্যায় বিচারের মাধ্যমে প্রমাণিত হোক।

শ্রমিক হত্যা মামলা

Advertisement

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। ভবনের নিচে চাপা পড়েন সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাক শ্রমিক। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

ওই ঘটনায় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলা দায়ের করেন।

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে। মামলার ৪১ আসামির মধ্যে আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা গেছেন। দুজনকে বাদ দিয়ে এখন আসামির সংখ্যা ৩৯ জন।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

ইমারত নির্মাণ আইনে মামলা

একই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় মামলাটি করেন।

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ১৩০ জনকে।

২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে ওই আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এখনও একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

দুই মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন) এ টি এম মাসুদ রেজা, প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসাইন, সাভার পৌরসভার মেয়র মো. রেফাতউল্লাহ, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, সাভার পৌরসভার সাবেক টাউন প্ল্যানার ফারজানা ইসলাম, লাইসেন্স পরিদর্শক মো. আব্দুল মোত্তালিব, পৌরসভার সাবেক সচিব মর্জিনা খান, সাবেক সচিব মো. আবুল বাশার, ফ্যান্টম এপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের এমডি বজলুস সামাদ ও ইথার টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান।

রানা ও তার বাবার বিরুদ্ধে আরও তিন মামলা

হত্যা ও ইমারত নির্মাণের দুই মামলা ছাড়াও রানার বিরুদ্ধে রয়েছে আরও মামলা। রানা প্লাজা ধসের পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুদক। নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সাভার থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদক। ভবনটি সোহেল রানার বাবার নামে হওয়ায় ওই সময় মূল অভিযুক্ত সোহেল রানাকে বাদ দিয়ে তার বাবা-মাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। তদন্তে সোহেল রানাই ভবনের মূল দেখভালকারী ছিল- প্রমাণ হলে চার্জশিটে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর পুনঃতদন্তে রানাকে অন্তর্ভুক্ত করে পুনরায় চার্জশিট দেয় দুদক।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ এম আতোয়ার রহমানের আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে দুদক এ বছর রানার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করে। বর্তমান মামলাটি তদন্তধীন। অপরদিকে তথ্য গোপন করার এক মামলায় রানার বাবা আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে দুদক একটি মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার ৭নং বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন।

তিন বছরের কারাদণ্ড রানার

সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার তিন বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের দণ্ড দেয়া হয়।

২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস এ রায় ঘোষণা করেন।

রানার মায়ের ৬ বছরের কারাদণ্ড

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমকে ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।

কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার সম্পদের ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা বাজেয়াপ্ত করেন আদালত।

চলতি বছরের ২৯ মার্চ ঢাকার ৬নং বিশেষ জজ আদালত কে এম ইমরুল কায়েস এ রায় ঘোষণা করেন।

জেএ/এমএআর/পিআর