বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকি সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় বিস্তৃত। বাংলাদেশের প্রধান চারটি ‘মাদার ফিশারিজ’র মধ্যে হাকালুকি হাওর অন্যতম। বিভিন্ন আকারের ২৭৬টি আন্তঃসংযুক্ত বিলের সমন্বয়ে গঠিত এই হাওরের আয়তন ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর। হাকালুকি হাওরের বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে জলজ বন। বিভিন্ন ধরনের জলজ ভাসমান উদ্ভিদ, শেকড়ধারী উদ্ভিদ, ওষুধি উদ্ভিদ ও অতিরিক্ত জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ প্রচুর জন্মে। এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে হিজল, করচ, বরুণ, বনতুলসী, নলখাগড়া, পানিফল, হেলেঞ্চা, বল্লুয়া, চাল্লিয়া প্রভৃতি। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির নানা ওষুধিসহ বৈচিত্র্যপূর্ণ ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির জলজ গাছ। বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী ও পাখির আবাসস্থল এ বন। সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং গরু-মহিষের অবাধ বিচরণ ও বনের গাছপালা কেটে নেওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে বনের জীববৈচিত্র্য। নানা সংকটের কারণে বিশাল এ জলজ বন রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই হুমকির শেষপ্রান্তে হাকালুকির জীববৈচিত্র্য।
Advertisement
বন বিভাগ ও মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভৌগলিকভাবে উত্তরে ভারতের মেঘালয়, পূর্বে ভারতের আসাম ও মণিপুর পাহাড় এবং দক্ষিণে ত্রিপুরা ও মিজোরাম পাহাড়ের পাদদেশ। ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উজানে প্রচুর পাহাড় থাকায়, পাহাড়ি ঢলে প্রতিবছরই হাকালুকি হাওর প্লাবিত হয়। এ সময় ছোট, মাঝারি ও বড় ২৭৬টি বিল পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে একটি বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়। এ সময় হাওরের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর। আর শুষ্ক মৌসুমে শুধু বিলের আয়তন প্রায় ৪ হাজার ৯২৫ হেক্টর। হাকালুকি হাওর বৃহত্তর মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা (৪০%), কুলাউড়া ও জুড়ী (৩০%) এবং বৃহত্তর সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ (১৫%), গোলাপগঞ্জ (১০%) এবং বিয়ানীবাজার (৫%) অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। এই হাওরাঞ্চলকে ঘিরে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ জীবনযাপন করছে। হাকালুকি হাওরের মৎস্য সম্পদ অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
বিশাল এ হাওরের জলজ জীববৈচিত্র্য রয়েছে হুমকির মুখে, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ। হাওর পাড়ের মানুষের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, বিভিন্নভাবে এই বনকে ধ্বংস করা হচ্ছে। বনের বড় বড় গাছগুলো কেটে নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু বন বিভাগের কোনো লোক তা দেখাশোনা করে না। বনের গাছপালা বর্ষায় হাওরের ঢেউ ঠেকায় যার ফলে তীরবর্তী বাড়িঘর-রাস্তাঘাট রক্ষা পায়। বর্ষা মৌসুমে মাছের খাদ্য ও আবাসস্থল হয়। বনের ভেতরে বন্যপ্রাণী ও পাখি আশ্রয় নিয়ে থাকে। বিভিন্ন মাছের খাবার এই জলজ উদ্ভিদ। মিঠা পানির সব প্রজাতির ছোট-বড় সুস্বাদু মাছ, অতিথি ও দেশীয় পাখি, নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, গুল্মলতা, নলখাগড়া ইত্যাদিতে ভরপুর ছিল হাকালুকি হাওর। পাওয়া যেত নানা জাতের ওষুধি লতাপাতা। বর্তমানে এ সব কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত।
হাকালুকি হাওরের প্রাণিবৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির শীতকালীন পরিযায়ী পাখিসহ প্রায় ৫৫৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে বিপন্ন, শংকটাপন্ন ও বিরল প্রজাতির বিভিন্ন বন্যপ্রাণী এ অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। এসব বন্যপ্রাণীর মধ্যে স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর ও সরীসৃপ উল্লেখযোগ্য। স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীর মধ্যে এখানে রয়েছে- মেছোবাঘ, শিয়াল, গন্ধগোকুল, বেজী, ইঁদুর ইত্যাদি। পাখির মধ্যে রয়েছে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল ও বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্কসহ বালিহাঁস, লেঞ্জা হাঁস, বেগুনি কালেম, পাতি কুট, মরিচা ভুতিহাঁস, পিয়ংহাস, পান্তামুখী, লালচেমাথা ভুতি হাঁস, লালশির, ডুবুরি, পানকৌড়ি, ডাহুক, সাদাবক, মাছরাঙা, বাংলা শকুন, সারস, শঙ্খচিল ইত্যাদি। এছাড়া উভচরের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েক প্রজাতির ব্যাঙ ও সরীসৃপের মধ্যে রয়েছে কয়েক প্রজাতির কচ্ছপ, সাপ, গিরগিটি ইত্যাদি। এছাড়াও এক হাজারেরও বেশি অমেরুদণ্ডি প্রাণীর আবাস রয়েছে এ হাওরাঞ্চলে।
Advertisement
হাওর পাড়ের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও গুল্মলতায় ভরাট ছিল প্রতিটি বিল। শীতকালে প্রতিটি বিল সিংরা, পানিফল, এরালী, শ্যাওলা ইত্যাদি নানা প্রজাতির গুল্মলতায় ভরপুর থাকতো। এসব গুল্মলতা এতো বেশি ছিল বা তাদের ঘনত্ব এতো বেশি ছিল যে, বাহির থেকে বিলে পানি দেখা যেত না। মাছের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বিলে প্রচুর পরিমাণ নানা প্রজাতির জলচর প্রাণী ও কীটপতঙ্গ ছিল। যা মাছ ও অতিথি পাখির খাবার জোগান দিতো। যেমন- ছোট-বড় শামুক, ঝিনুক, গুগাইল, ফোটকোনাসহ নাম না জানা অসংখ্য কীটপতঙ্গ। প্রতিটি বিল ছিল গভীর; তাতে বড় বড় সুস্বাদু রুই, কাতলা, মৃগেল, কালো বাউস, আইড়, বোয়াল, শোল, গজার, পাঙ্গাস, ঘনিয়া ও ছোট প্রজাতির কই, মাগুর, পাবদা, সিং, পুটি, টেংরা, ভেড়া, মলা, রানি, বাঁচা মাছসহ সব প্রজাতির মাছ। এককালে ইলিশাও পাওয়া যেত। এককথায় এমন কোনো প্রজাতির মাছ ছিল না, যা হাওরে পাওয়া যেত না। অনেক প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। যেমন- পাঙ্গাস, ঘনিয়া, পাবদা, রানি, সিং, মাগুরসহ আরও অনেক।
একসময়ের সারি সারি হিজল গাছ এখন আর নেই। নিয়ম-কানুন অমান্য করে জ্বালানী কাঠের জন্য হিজল গাছ কেটে নেওয়ায় হাকালুকি হারিয়েছে তার যৌবন, বিপন্ন হয়েছে জীববৈচিত্র্য। হাকালুকি হাওরের সব হিজল গাছ সাবাড় হয়ে বর্তমানে এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। অথচ সমগ্র হাকালুকি হাওরে হাজার হাজার হিজল গাছ ছিল। পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকেরা জ্বালানি হিসেবে বাড়ির পাশের গুল্মলতা কেটে নিতে থাকায় তা-ও আজ সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে গেছে।
পরিবেশকর্মী কবির আহমদ জানান, এরই মধ্যে গাছ কাটার বিষয়টি প্রশাসন, বন বিভাগ ও পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। গোপনে গাছ কাটা ও বনের ভেতর গরু-মহিষের অবাধ বিচরণে এখন বন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দে জাগো নিউজকে জানান, একজন বনরক্ষী দিয়ে গরু-মহিষের অবাধ বিচরণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি এই বিশাল হাওরের গাছ কাটাও বন্ধ করা যাচ্ছে না। এর জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এছাড়া হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বন বিভাগ কাজ করছে। আরো কিছু বনভূমি সৃষ্টির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
Advertisement
রিপন দে/এসইউ/পিআর