শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা। কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভাঙা অবস্থায় নিয়ে আসা হয় স্কুলশিক্ষক মজিবর রহমানকে। কিন্তু জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) প্রবেশ পথে মজিবর রহমানের পরিবারের সামনে দাঁড়ায় এক দালাল। কিছু বুঝে উঠার আগেই মজিবরকে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে নিয়ে যায়। এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে পঙ্গু হাসপাতালে।
Advertisement
হাসপাতালটিতে আসা রোগীর স্বজন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পঙ্গু হাসপাতালকে পঙ্গু করে রেখেছে একাধিক দালাল চক্র। এ দালাল চক্রকে খাটান ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই। জড়িত রয়েছে ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকের মালিক ও খোদ হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল) কর্তৃপক্ষ বলছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় আগের তুলনায় দালাল চক্রের তৎপরতা কমেছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান-পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর স্বজনরা বলছেন, শতাধিক দালাল হাসপাতালে নিত্যদিন ঘোরাঘুরি করেন। সুযোগ বুঝে রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে চলে যান প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা হাসপাতালে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ এলাকার সহজ সরল রোগীর স্বজনদের নেতিবাচক নানা কথা বলে থাকেন তারা। রোগীর স্বজনরা বলছেন, এক্ষেত্রে পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং কারও কারও যোগসাজশ রয়েছে। এখানে নিয়মিত ডাক্তারদের পরিদর্শন না হওয়া ও দিনের পর দিন চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা বড় কারণ। পঙ্গু হাসপাতালে মাঝে মাঝে অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে গত দুই বছরে দেড় শতাধিক দালালকে আটক ও জেল জরিমানা করেছে এলিট ফোর্স র্যাব।
র্যাব বলছে, ৮ থেকে ১০ জন দালাল একেকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তাদের অপতৎপরতা চালায়। এরা দিনে ৫ থেকে ৬ বার ধরনা দেয় এ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া হাত-পা ভাঙা রোগীর স্বজনদের কাছে। রোগীর স্বজনদের এখানকার চিকিৎসা সম্পর্কে নেতিবাচক নানান কথা বলে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এক পর্যায়ে রোগীকে হাসপাতাল থেকে বাগিয়ে আশপাশের প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যায়। ওই রোগীর কাছ থেকে প্রাইভেট ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ যে টাকা আয় করে তার শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ কমিশন তারা পায়। এ চক্রের সঙ্গে হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারী ও নার্সের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে(পঙ্গু হাসপাতাল) অভিযান চালিয়ে ২২ দালালকে আটকের পর দোষ স্বীকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেয় র্যাব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। এভাবে দালাল চক্রের সদস্যকে কখনও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা ও কখনও মামলা দিয়ে থানা পুলিশে দিয়েছে র্যাব।
Advertisement
পঙ্গু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে কেবিন, ওয়ার্ড, প্যাথলজি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটারসহ বহির্বিভাগ পর্যন্ত দালাল সিন্ডিকেট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দালালদের কাছে ডাক্তাররা পর্যন্ত অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। এছাড়া উন্নত চিকিৎসার কথা বলে প্রাইভেট ক্লিনিকে বাগিয়ে নেয়ার কমিশন তো রয়েছেই। ফলে দালালদের দৌরাত্ম্যে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে পঙ্গু হাসপাতাল।
দালাল চক্রের বিরুদ্ধে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং রোগী ও স্বজনদের হয়রানি থেকে রক্ষায় র্যাব কাজ করে যাচ্ছে। পঙ্গু হাসপাতালে একাধিকবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দালাল চক্রের সদস্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। আটককৃতরা পঙ্গু হাসপাতালের রোগীদের বিভিন্নভাবে আশপাশের বেসরকারি ক্লিনিকে বাগিয়ে নিয়ে যেত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একই ব্যক্তি একাধিকার আটক হয়েও একই পেশায় ফিরে অপরাধে জড়িয়েছেন।তিনি বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন মেয়াদে শতাধিক ব্যক্তিকে সাজা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন স্থানীয় সততা ক্লিনিকের, দু’জন মক্কা ক্লিনিকের ও একজন মুন্নি ডায়াগনস্টিকের বেতনভুক্ত কর্মচারী। সাজা দেয়া হয়েছে পঙ্গু হাসপাতালের চার কর্মচারীকেও। আবার একই ব্যক্তি জামিনে বেরিয়ে আটকের পর ফের সাজাভোগ করেছেন। পঙ্গু হাসপাতালে দালাল চক্র নতুন করে মার্কেটিং অফিসারের নামে রোগী ও স্বজনদের হয়রানি করছে বলেও জানা তিনি।
র্যাব-২ এর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটি অংশ দালাল চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারা দালালদের মাধ্যমে নিজেদের মালিকানা কিংবা লভ্যাংশের লোভে রোগীদের ভাগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। জড়িত রয়েছে স্টাফরাও। তিনি আরও বলেন, এই পঙ্গু হাসপাতালে সবচেয়ে বড় সমস্যা ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়া দুর্ঘটনার রোগীকে ভর্তি না করার নিয়ম। এ ধরনের অনিয়মের কারণে দালালচক্র রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সহজে।
পঙ্গু হাসপাতালের নিচতলায় বেড নং ১৭ এ চিকিৎসাধীন যশোর ঝুমঝুমপুর এলাকা থেকে আসা মিজানুর রহমান। সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গেছে তার। তিনি শনিবার দুপুরে জাগো নিউজকে বলেন, ১৭ দিন ধরে হাসপাতালে আছি। এখানকার চিকিৎসায় উন্নতি খুব একটা দেখছি না। অনেকেই এখানে এসে আমাকে প্রাইভেট হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু যাইনি অর্থাভাবে। যদিও পরে জেনেছি পরামর্শদাতারা দালাল চক্রের।
Advertisement
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. আবদুল গণি মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, দালালদের বিষয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রায়ই প্রশাসনের সহযোগিতায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে দালালদের। তিনি বলেন, হাসপাতালের সামনের দোকানগুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে। রোগী ও স্বজনদের যাতে হয়রানি করতে না পারে সেজন্য বাইরের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। দালাল থেকে সাবধান থাকতে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগিয়ে হাসপাতালের সর্বত্র মনিটরিং করা হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া মাত্র ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
জেইউ/ওআর/আরআইপি