দেশজুড়ে

হার না মানা মানিক মাস্টার

ছোট্ট স্বপ্না পাঁচটা এক টাকার চকলেট হাতে গুটি গুটি পায়ে হাজির। গতকাল পড়তে আসেনি, তারই শাস্তি স্বরূপ চকলেট হাতে স্যারের সামনে আগমন। মানিক স্যার হাসতে হাসতে আদরে জড়িয়ে নিলেন ছাত্রীকে। একদিন রাগের স্বরেই বলেছিলেন একদিন না এলে জরিমানা হিসেবে চকলেট নিয়ে আসতে হবে, সে মোতাবেক হাতে চকলেট নিয়ে হাজির স্বপ্না!

Advertisement

বাচ্চাদের সঙ্গে এমনই বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক মুজাহিদুল ইসলাম মানিকের। দুপুরের পর থেকেই এক রুমের এই কামরা সরগরম হতে থাকে বাচ্চাদের কিচির মিচিরে। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পড়তে চলে আসে মানিক স্যারের কাছে। পড়া দেয়া থেকে পড়া শেষ করার আগ অব্দি ছুটি নেই কারো। পারিবারিক অবস্থা খুব বেশি স্বচ্ছল নয় কারোরই। তাই বেতনও নির্ধারিত নয় কারো। দিলে দিলো, না দিলে নেই, এ নিয়ে খুব বেশি আক্ষেপও নেই টানাপোড়নের জীবনের মানিক স্যারের।

২০০০ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী মানিকের জীবনটা হুট করেই বদলে যায় তৃতীয় বিষয় ইংরেজী পরীক্ষার আগের দিন রাতে। কোমরে হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা, সেরাতে মনে হচ্ছিল জীবনে আর সকালই আসবে না বুঝি। তবুও ব্যথায় কাতরানো সকাল এলো জীবনে, পরীক্ষা বাদ দেয়া যাবে না। ব্যথা নিয়েই হাজির পরীক্ষা কেন্দ্রে। ব্যথা সয়েই একটা একটা করে সবকটা পরীক্ষা শেষ। নিজের অজান্তেই পেলে পুষে পাকাপোক্ত করছিলেন সমস্যাটাকে। পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার অব্দি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেলো। তার ওপরে সময়মত ওষুধ সেবন করতে না পারা, আর্থিক টানাপোড়ন তো রয়েছেই। পরীক্ষার রেজাল্ট হাতে। মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ মানিক কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারেননি চিকিৎসায়। ভুগছেন এনকাইলজিংক স্পোন্ডাইলাইটিস রোগে। কোমর আর মেরুদণ্ডের সংযোগে স্থায়ী বসবাস এই রোগের। ফলস্বরূপ শরীরের নিম্নাংশ প্রায় অচল। হাঁটাচলা স্ক্রেচে ভর করে তাও টুকটাক!

আল আমিন মাদরাসার এতিমখানায় বড় হওয়া মানিক বাবাকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। মা মানুষের বাড়ি কাজ করে সংসার চালাতেন। একমাত্র বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে যান। শুরু থেকেই টানাপোড়নের সংসারে মানিকের এই সমস্যা বিভীষিকার মতো নেমে আসলো। দাখিল শেষ করলেও আলিম আর শেষ করা হলো না। ছাড়তে হলো এতিমখানাও। পুরোপুরি ঘরবন্দি মানিক। ততোদিনে বয়সের ভারে মা মনোয়ারাও ছেড়েছেন ঘর বাড়ির কাজকর্ম। ঘরে সৎ বাবা থাকলেও মানিকের কোনো দায় দায়িত্বই নিতে রাজি নন তিনি। দুই রুমের এই ঘরের এক রুমে মা আর সৎ বাবা অন্য রুমে মানিক আর টিঊশন সার্ভিস। এলাকায় তিনি পরিচিত মানিক মাস্টার নামে।

Advertisement

সব হারিয়েও মুচড়ে পড়েননি মানিক। একসময় স্বপ্ন দেখতেন পড়াশোনা শেষ করে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্টা করেবেন গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য। এখন আর সেই সাহস পান না। তবুও দমে যাননি। নিজ বাসার আশেপাশের দারিদ্র্যপীড়িত বাচ্চাদের দিয়ে শুরু করলেন শিক্ষা কার্যক্রম। শুরুটা কঠিন ছিল তবে আস্তে আস্তে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়তে থাকল। সংসার চলে যায় স্বাচ্ছন্দ্যেই। তবে ইদানীংকার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কমে এসেছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। তবুও আক্ষেপ নেই, যা আছে চলে যাচ্ছে।

ছয়মাসে একবার প্রতিবন্ধী ভাতা পান। যার পুরোটাই তুলে দেন মায়ের হাতে। মা মনোয়ারার চোখ ছলছলে। নিজের দামাল ছেলেকে এভাবে ঘরে পড়ে থাকতে দেখতে কারইবা ভালো লাগে! তবুও কারো কাছে হাত পাততে রাজী নন মা ছেলে কেউই। যা আছে যতটুকু আছে সে যোগ্যতাতেই এগুতে চান সামনে।

এফএ/এমএস

Advertisement