বিশেষ প্রতিবেদন

আন্দোলনে আগ্রহ হারাচ্ছে বিএনপি?

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে ডাকা বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রথম দিকে বেশ সরব ছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। সে সময় নেয়া কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু আস্তে আস্তে যেন তারা ঝিমিয়ে পড়েছেন। খোদ দলটির কেউ কেউ মনে করছেন, এখন আর আন্দোলন তেমন হচ্ছে না।

Advertisement

সম্প্রতি সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অসুস্থতা, তার মায়ের মৃত্যুর পাশাপাশি, পুলিশ হেফাজতে ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেন মিলনের মৃত্যুর অভিযোগ নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। কৌশলগত কারণে বিএনপি এখন ঢাকার বাইরে কর্মসূচি পালন করছে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া কারগারে যাওয়ার পর বিএনপির পক্ষ থেকে ওই মাসে টানা ১৩ দিন বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। এর মধ্যে মানববন্ধন, কালো পতাকা প্রদর্শন, বিক্ষোভ-সমাবেশ ছিল উল্লেখযোগ্য।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ফটক থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। পরের দিন ঠিক একই স্থান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি দৈনিক বাংলার মোড় অতিক্রম করে ফকিরাপুল পানির ট্যাঙ্কির সামনে গেলে পুলিশ তা পণ্ড করে দেয়।

Advertisement

১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন, ১৩ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি, ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন কর্মসূচি, ১৭ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি, ১৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি পেশ, ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বাইরে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে দলটি।

২৪ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশি বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার থানাগুলোতে প্রতিবাদ মিছিল কর্মসূচি পালন করা হয়। অভিযোগ ওঠে, ওই দিন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন না করে দলটির নেতাকর্মীরা ফটোসেশনে ব্যস্ত থাকেন।

এর আগে ২২ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে পহেলা মার্চ সারাদেশে লিফলেট বিতরণ করে বিএনপি। ৬ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধন থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে আটক করা হয়। এদিন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা অস্ত্র উঁচিয়ে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে শফিউল বারীকে আটক করে নিয়ে যায়।

দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলীয় এসব কর্মসূচি চলাকালে তাদের বেশকিছু নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। অনেকে হয়রানি আতঙ্কে গাঢাকা দেন। বিশেষ করে পুলিশ হেফাজতে ছাত্রনেতা জাকির হোসেন মিলনের মৃত্যুর অভিযোগ সামনে আসার পর নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

Advertisement

১২ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আবারও সমাবেশের কথা বলা হলেও শেষপর্যন্ত সেটাও সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ঢাকার বাইরে সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি তাদের আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। ইতোমধ্যে বরিশাল, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী শহরে বিএনপি জনসভা করেছে।

ঢাকার বাইরে জনসভা করলেও রাজধানীতে সেই পরিস্থিতি নেই বলে জানান দলের শীর্ষ নেতারা। যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে বিএনপির দফতরের দায়িত্বে থাকাকালে অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ কিছু সংগঠনকে ‘ভুঁইফোঁড়’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সেসব সংগঠনের ব্যানারে বর্তমানে জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কেন্দ্রীক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

গত ২০ মার্চ বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দলীয়প্রধানের মুক্তি আন্দোলনের গতি বাড়ানোর তাগিদ দেন। ওই সময় তিনি বলেন, ‘যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট দেশের উচ্চতর আদালত; আমরা পছন্দ করি আর না করি, তাদের রায় আমাদের মেনে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সময় এসেছে কতদিন আর আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করব? একটা পর্যায় আসবে দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আর চাইবে না। তখন বাধ্য হয়ে আমাদের তাদের সঙ্গে থাকতে হবে।’

এর আগে ১৬ মার্চ বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, চিকিৎসকরা প্রস্তুত হলে সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি এখন আঙুল বাঁকা করতে পারবে। একটু সময় দেন, আপনারা রেডি হলে আমরা আঙুল বাঁকা করতে পারব। চিকিৎসকদের মানুষ ভালোবাসে, বিশ্বাস করে।’

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মহাসচিব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। চেয়ারপারসনের মুক্তি দাবির আন্দোলন চলাকালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েকদিন অসুস্থ ছিলেন, ওনার মাও ছিলেন লাইফ সাপোর্টে।এরপর মায়ের মৃত্যুতে সাংগঠনিক কর্মসূচি থেকে একেবারেই দূরে ছিলেন তিনি। ফলে ঢাকায় আন্দোলনের মাত্রা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তবে ঢাকার বাইরে যেসব কর্মসূচি চলছে তা আন্দোলনেরই অংশ।

এছাড়া গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণও আন্দোলনের অংশ, জানান তারা।

খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপি ‘আন্দোলনের হালে পানি পাচ্ছে না’- বিভিন্ন মহলের এমন দাবি মানতে নারাজ দলটির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সেলিমুজ্জামান সেলিম।

এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। আন্দোলন চলছে, প্রবল আন্দোলনে সরকারের পতন নিশ্চিত হবে এবং আমাদের নেত্রী মুক্তি পাবে, দেশের জনগণ মুক্তি পাবে।’

আন্দোলন প্রসঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা আর পেছনে যেতে পারব না। আমরা পেছনে না গেলে আওয়ামী লীগও সামনের দিকে আসবে। আর সামনের দিকে আসলে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমরা সেই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাই। তাই আমরা বারবার আন্দোলন ও ভোটের কথা বলি। আমাদের আন্দোলন ভোটের দাবি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।’

গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে দফতরের দায়িত্বে থাকা দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী আহমেদর কাছে প্রশ্ন করা হয়, আপনাদের আন্দোলন চলছে না। এ প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার জন্য তার প্যারোলে মুক্তি চাইবেন কিনা? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘কে বললো আন্দোলন নেই? গতকাল রাজশাহীতে যে এত বড় জনসভা হলো। সেখানে জায়গা দেয় না, কিছুই দেয় না কিন্তু হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হলো। সেটি কি আন্দোলনের অংশ নয়?’

তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে নানা ধরনের কর্মসূচি থাকে। সেখানে (রাজশাহী) দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া হয়েছে। এটা তো কর্মসূচির অংশ হিসেবেই ঘোষণা করা হয়েছে। তার চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে- এটা তো আন্দোলনেরই অংশ।’

রিজভী সাংবাদিকদের কাছে উল্টো প্রশ্ন রাখেন, আপনাদের এ বিষয়ে কে জানালো? কীভাবে জানলেন? তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলন চলছে, অব্যাহত গতিতে চলছে। সামনে আরও তীব্র হবে।’

কেএইচ/এমএআর/এমএস