মতামত

গণপরিবহনে ধর্ষণ : পাশবিকতার শেষ কোথায়?

রাষ্ট্র হিসেবে আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছি সেই সাথে নতুন উদ্যমে আবার সকলে মিলে সামনে এগিয়ে যাবার দৃপ্ত শপথ নিয়েছি। ক্রমান্নয়ে আমরা যখন একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে পথিবীর মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য লড়াই করছি তখনই অব্যাহত ভাবে নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে।

Advertisement

যেখানে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ইতোমধ্যে নারীর সম অধিকার, নারীর প্রতি ন্যায়বিচার, নারীর জন্য নিরাপদ আবাসস্থল, কর্মস্থল, নিরাপদে পথচলা নিশ্চিত করার কথা সেখানে আমরা যেন উল্টো পথে হাঁটছি। নিত্য একটার পর একটা ধর্ষণের সংবাদ আমাদের চোখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, জাতি হিসেবে আমাদের অপরাধী করে তুলছে। ধর্ষণের মতো ঘটনা এত বেশি পরিমাণে ঘটছে যে অপরাধগুলো খুব দ্রুত আবার চাপাও পড়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির আড়ালে।

আমরা যখন তনুকে নিয়ে সোচ্চার হয়ে হয়ে উঠি, জেগে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশ, তখন সামনে চলে আসে রুপা হত্যার খবর। আমরা যখন রুপাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করি তখন লোমহর্ষক বেদনাবিধূর এমন আরো একটি সংবাদ সামনে এসে উপস্থিত হয়।

সর্বশেষ ৯ এপ্রিল সোমবার এমনই আরো একটি ধর্ষণের ঘটনা আমাদের নজরে আসে। চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয় এক নারী পোশাককর্মী। দূরে নয় রাজধানীর অতি নিকটে সংগঠিত হয় ভয়াবহ এই অপরাধটি। পত্রিকা মারফত জানা যায়, ঢাকার ধামরাইয়ে গত রবিবার রাত ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে।

Advertisement

আমরা জানতে পারি যে, ধামরাইয়ে শ্রীরামপুরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন ওই নারী। রাত আনুমানিক নয়টার দিকে কারাখানা ছুটি হলে তিনি বাসায় যাওয়ার উদ্যেশ্যে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় ঢাকাগামী যাত্রীসেবা পরিবহন নামের একটি বাস এলে এতে তিনি উঠে পড়েন।

বাসটি শ্রীরামপুর থেকে পরের স্টেশনে কালামপুরে গেলে সব যাত্রী নেমে যায়। ওই পোশাককর্মী তখন বাসের ভেতর একা হয়ে যান। এ সুযোগে বাসের চালক বাবু ও মিস্ত্রি আবদুল আজিজ তাকে ধর্ষণ করে। তখন বাস চালাচ্ছিল সোহেল নামের একজন। অন্যরা এই নারী পোশাককর্মীকে হাত-পা ধরে রাখে। এ সময় ওই সড়ক দিয়ে টহল পুলিশ যাচ্ছিল। সে সময় মেয়েটির চিৎকারে পুলিশ বাসটিকে থামতে সংকেত দেয়। কিন্তু চালক সংকেত অমান্য করে গাড়ি চালিয়ে যায়।

পরে পুলিশ সাত কিলোমিটার ধাওয়া করে বাসটিকে আটক করে, সেই সাথে ওই নারীকে উদ্ধার করে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। ঘটনার বিবরণ শুনে গা শিউরে ওঠে। এসব হচ্ছে কী? কোন পথে যাচ্ছি আমরা? এর শেষ কোথায়?

পুলিশকে ধন্যবাদ জানাই এই কারণে যে, ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের ইতোমধ্যে তারা আটক করেছেন। হাতেনাতে আটক করার কারণে এখন হয়তো ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা অনেকটাই সহজতর হবে বলে আমরা মনে করি।

Advertisement

ইতিপূর্বে আমরা এধরনের আরো লোমহর্ষক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। এখনও ভুলতে পারিনি রুপার কথা। রুপার পরিণতি হয়েছিল আরো ভয়াবহ। গেল বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রূপা খাতুন চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।

দুর্বৃত্তরা তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যায়। তারপর বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছিল রুপার লাশ। বিষয়টি জানাজানি হলে তার স্বজনরা ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করে।

হ্যাঁ এই অপরাধের আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। মামলার রায়ে আদালত বাসটির চালক হাবিবুর, চালকের সহকারী শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীরকে ফাঁসির আদেশ দেন। আর বাসের সুপার ভাইজার সফর আলীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। কিন্তু এমন উদাহরণ আমাদের সামনে তেমন নেই বললেই চলে। যে কারণে এমন অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে দিনকে দিন।

পরিসংখ্যান বলছে, আগের তুলনায় ইদানিং গণপরিবহনে নারী ধর্ষিত হচ্ছে অনেক বেশি। এবং এর বেশিরভাগই গণধর্ষণ। গণধর্ষণের ঘটনা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে গণপরিবহনে। এসব ঘটনায় নারীদের জন্য ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে রাতের সড়ক।

গণপরিবহনে গণধর্ষণের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের শুভেচ্ছা পরিবহনের চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণ, ২০১৫ সালের ১২ মে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে বাসচালক ও চালকের সহকারী মিলে চলন্ত বাসে এক পোশাক কর্মী ধর্ষণ, ঢাকায় এক গারো তরুণীকে চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণ, ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি বরিশালে সেবা পরিবহনের একটি বাসে পাঁচ পরিবহন কর্মী মিলে দুই বোনকে ধর্ষণ, ওই বছরের ১ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী থেকে ঢাকাগামী বিনিময় পরিবহনের একটি বাসে ধর্ষণের শিকার এক পোশাক কর্মী, ও ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের নান্দাইলে বাসে এক কিশোরীকে ধর্ষণ।

এর বাইরে এমন আরো অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা আমরা জানতে পারিনি, পত্রিকার পাতায় সংবাদ হয়ে না আসার কারণে। অনেকে আবার চেপে যায়। নির্যাতিত হয়েও সমাজপতিদের চাপে চেপে যেতে বাধ্য হয়, কখনওবা পরিবারের কথা চিন্তা করে চুপ থাকে।

দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা এখনও নারীদের জন্য নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। গণপরিবহনের যাত্রী হয়ে অসংখ্য নারী প্রতিদিন নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এসব ঘটনার সবটাই গণমাধ্যমে আসে না। হরহামেশাই বাস, ট্রেন, লঞ্চ বা অন্য কোন গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে তারা অনাকাঙ্খিত স্পর্শ, বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গি, কটূক্তির শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি যৌন হয়রানির এই মাত্রা চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছেছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারা দেশে গত ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, গত ১৩ মাসে বাস চালক- হেলপার ও তাদের সহযোগীরা ৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে৷ এসব ঘটনায় ৫৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে৷

সারাদেশে অসংখ্য নারী প্রতিদিন পেশাগত কাজে কিংবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গণপরিবহনে চলাচল করছে। সমাজের নিন্ম আয়ের মানুষেরাই সাধারণত গণপরিবহন ব্যবহার করে। যারা মূলত গতিশীল রাখছে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির চাকা। খোদ ঢাকায় শুধুমাত্র পোশাকখাতেই নিয়োজিত রয়েছে, দশ লক্ষেরও অধিক নারী কর্মী।

অন্যান্য সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছে আরো অসংখ্য নারী কর্মী। কিন্তু তাদের জন্য নিরাপদে, নিশ্চিন্তে পথচলার কোন ব্যবস্থা নেই। যে কারণে নিত্য আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে নারী ধর্ষণের মতো ভয়াবহ সংবাদ। দেশের মোট জনগোষ্ঠির অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে তাদের পীড়নের মধ্যে রেখে দেশ এগিয়ে যাবে তা কীভাবে সম্ভব!

আমরা চাই আজ থেকেই বন্ধ হোক, নারীর প্রতি যতসব সহিংস আচরণ। নিরাপদ হয়ে উঠুক লক্ষ- কোটি নারীর পথচলা। গণপরিবহন হোক নারীবান্ধব। কিন্তু আমরা চাইলেই কি হবে? না, আমাদের সাথে সাথে রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস