অর্থনীতি

তবু শীর্ষে ব্যাংক

শেয়ারের লেনদেন ধারাবাহিকভাবে কমলেও গত কয়েক মাসের মতো মার্চেও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে দেশের ব্যাংক খাত। শেয়ারবাজারের প্রাণ হিসেবে পরিচিত এ খাত টানা আট মাস লেনদেনের শীর্ষস্থানে রয়েছে। 

Advertisement

প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণ, পরিচালকদের অনৈতিক কার্যক্রমসহ ব্যাংক খাত সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক তথ্য বেরিয়ে আসায় আর্থিক খাতের ওপর এক ধরনের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, ব্যাংক খাত খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। ফলে ব্যাংকের প্রতি আস্থা কমেছে।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমার কারণে ব্যাংক খাতের শেয়ার লেনদেনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে মার্চ মাসের শেষ পর্যায়ে এসে সরকারের সিদ্ধান্তে ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) সাড়ে ছয় শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করা এবং সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেনে। ফলে লেনদেনের শীর্ষস্থানটি ব্যাংকের দখলেই রয়েছে।

Advertisement

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মার্চ মাসে লেনদেনের শীর্ষস্থান ব্যাংক খাতের দখলে থাকলেও টাকার অংক এবং শতাংশের হিসাবে আগের মাসের তুলনায় কমেছে। মার্চ মাসজুড়ে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয়েছে এক হাজার ২৪ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয় এক হাজর ২৪৩ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৬ দশমিক ১৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের শেয়ারবাজারে ব্যাংক খাত সব সময় একটি বড় ভূমিকা রাখে। তবে ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধস এবং পরবর্তীতে হল-মার্কসহ ব্যাংক খাতের বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। এতে কিছুটা হলেও ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারেও দেখা যায়।

তিনি বলেন, সম্প্রতি ব্যাংক খাতের জন্য যে সুবিধা (সিআরআর কমানো এবং সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে দেয়া) দেয়া হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয়। এতে ঋণের প্রবাহ বেড়ে অযোগ্যদের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যেতে পারে। ব্যাংক খাতকে দেয়া এ সুবিধার সঙ্গে শেয়ারবাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ দেখা গেল ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ব্যাপক উত্থান হলো। বিনিয়োগকারীরা হুজুগে মাতার কারণে এমনটি হয়েছে।

ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ডিএসইর বাজার মূলধনের অর্ধেকই ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক খাতের। এর মধ্যে ব্যাংক খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। যে কারণে ব্যাংক খাত ভালো থাকলে সার্বিক শেয়ারবাজারও ভালো থাকবে। সিআরআর কমানো এবং সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার ফলে আর্থিক বাজারে তারল্য বাড়বে। এতে আশা করা যায় আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তারল্য সংকট থাকবে না।

Advertisement

এদিকে লেনদেনের শীর্ষস্থান ধরে রাখলেও গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংক খাতের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয় আট হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। পরের মাস অক্টোবরে তা কমে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৪১৭ কোটি টাকায়। এ ধারা অব্যাহত থাকায় নভেম্বরে ছয় হাজার ৭৬ কোটি, ডিসেম্বরে দুই হাজার ১৩৬ কোটি, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এক হাজার ৯০০ কোটি এবং ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ২৪৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়। আর মার্চে লেনদেন হয় এক হাজার ২৪ কোটি টাকা।

ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন এমন ধারাবাহিকভাবে কমায় সার্বিক বাজারেও লেনদেনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাপ পড়েছে। ডিএসইতে মার্চ মাসে শেষ ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে। মার্চে মোট লেনদেন হয়েছে ছয় হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে গত ১৫ মাসের মধ্যে এক মাসে ডিএসইতে এত কম লেনদেন হয়নি।

 ডিএসইর শেষ ১৫ মাসের লেনদেন চিত্র 

মাস

টাকা

জানুয়ারি- ২০১৭

৩৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা

ফেব্রুয়ারি- ২০১৭

১৯ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা

মার্চ- ২০১৭

২১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা

এপ্রিল- ২০১৭

১৫ হাজার ২২৩ কোটি টাকা

মে- ২০১৭

১২ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা

জুন- ২০১৭

১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা

জুলাই- ২০১৭

২০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা

আগস্ট- ২০১৭

১৯ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা

সেপ্টেম্বর- ২০১৭

১৯ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা

অক্টোবর- ২০১৭

১৫ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা

নভেম্বর- ২০১৭

১৮ হাজার ৪২১ কোটি টাকা

ডিসেম্বর- ২০১৭

৯ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা

জানুয়ারি- ২০১৮

১০ হাজার ৭২ কোটি টাকা

ফেব্রুয়ারি- ২০১৮

৭ হাজার ৫২২ কোটি টাকা

মার্চ- ২০১৮

৬ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা

 ডিএসইর খাত ভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মার্চ মাসে ডিএসইতে লেনদেনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওষুধ খাত। ফেব্রুয়ারি মাসেও এ খাতটি দ্বিতীয় স্থানে ছিল। মার্চজুড়ে ওষুধ খাতের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৯৯৪ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগের মাসে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয় এক হাজার ১৪৪ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।

তৃতীয় স্থানে থাকা প্রকৌশল খাত ফেব্রুয়ারিতেও তৃতীয় স্থানে ছিল। মার্চে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৯২৪ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয় এক হাজার ৩০ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।

অপরিবর্তিত রয়েছে চতুর্থ স্থানটিও। ফেব্রুয়ারির মতো মার্চেও লেনদেনের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বস্ত্র খাত। মার্চে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৭৪৯ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ। আগের মাসে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয় ৮৬৪ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ।

বাকি খাতগুলোর মধ্যে মার্চে চার শতাংশের ওপরে এককভাবে অবদান আছে চারটি এবং তিন শতাংশের নিচে আছে ১০টি খাতের। মোট লেনদেনের চার শতাংশের ওপরে থাকা খাতগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আট দশমিক ৫৬ শতাংশ, খাদ্যের পাঁচ দশমিক ৮১ শতাংশ, আর্থিক খাতের চার দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং বিবিধ খাতের চার দশমিক ১৪ শতাংশ অবদান রয়েছে।

এছাড়া টেলিকমিউনিকেশন খাতে তিন দশমিক ৯৮ শতাংশ, সিরামিকের তিন দশমিক ৩৪ শতাংশ, বীমার দুই দশমিক ৮২ শতাংশ, আইটির দুই দশমিক ৬৭ শতাংশ, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দুই দশমিক ৬১ শতাংশ, চামড়ার দুই দশমিক ১০ শতাংশ, ভ্রমণের এক দশমিক ৫৭ শতাংশ, সিমেন্টের এক দশমিক ৫৭ শতাংশ, সেবা ও আবাসনের দশমিক ৮৩ শতাংশ, পাটের দশমিক ৩২ শতাংশ, কাগজ ও মুদ্রণের দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ এবং বন্ডের দশমিক শূন্য ১ শতাংশ অবদান রয়েছে।

এমএএস/এমএআর/আরআইপি