দেশজুড়ে

সিসিক নির্বাচনে আরিফ-কামরানের প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিম-আসাদ

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন এগিয়ে আসছে। আগামী জুন-জুলাইয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে প্রচার প্রচারণা।

Advertisement

বর্তমান মেয়র মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আরিফুল হক চৌধুরী ও সাবেক মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন এতোদিন অনেকটা নিশ্চিত থাকলেও হঠাৎ করে চলতি বছরের শুরুতে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আসাদ।

প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনী প্রচারণায় নামায় অনেকটা বেকায়দায় পরেছেন আরিফ ও কামরান। খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যেভাবে বর্তমান মেয়র ও প্রভাবশালী নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন মুখ প্রার্থী করায় তাদের বেলায়ও এমন মডেল অনুসরণ করা হবে কি-না এ চিন্তায় আরিফ-কামরানের এখন ঘুম হারাম। তাদের গলার কাটায় পরিণত হয়েছেন এক সময়ের ঘনিষ্ট সহচর সেলিম-আসাদ। এনিয়ে সচেতন নাগরিকরাও নানা হিসেব নিকেশ শুরু করেছেন।

তবে ইতোমধ্যে কামরানের অনুসারীরা দলীয় প্রার্থী হিসেবে গ্রীন সিগন্যাল পাওয়ার প্রচারণা চালিয়ে গেলেও অনসন্ধানে এর সত্যতা মিলেনি।

Advertisement

সিসিকের বর্তমান ও সাবেক মেয়রের স্থলাভিষিক্ত হতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের নিজ দলীয় মহানগর শাখার দুই সাধারণ সম্পাদক। তারা বলছেন, নগরবাসী নতুন নগরপিতার প্রতীক্ষায়। আর নগরবাসীর এ প্রতীক্ষার অবসান ঘটাতেই তৃণমূলের চাহিদা ও নগরবাসীর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। আর এতে নগরবাসীর বিপুল সাড়াও রয়েছে।

এদিকে বর্তমান ও সাবেক মেয়র দু’জন দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতা। কামরান ছিলেন দু’বার সিসিক মেয়র ও একবার তৎকালীন সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান। অপরজন বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী গত সিসিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।

সিলেটের মানুষের কাছে এই দুজনই আলোচিত ব্যক্তি। সমালোচনাও আছে তাদেরকে নিয়ে। দু’জনই দুর্নীতির দায়ে কারাভোগ করেছেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।

কামরান মনোনয়ন পাবেন এবং তাকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রীন সিগন্যাল দিয়েছেন বলেও তিনি দাবি করছেন। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কাজ করে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে দাবি আরিফুল হকের। তাই তারা মনোনয়ন পাবেন বলে প্রত্যাশা করছেন।

Advertisement

সূত্র মতে, মনোনয়নের প্রত্যাশা নিয়ে ঘরে বসে নেই এ দুই নেতা। রীতিমতো চালিয়ে যাচ্ছেন লবিং-তদবির। তাদের দৌঁড়ে পিছু নিয়েছেন সাবেক দুই ছাত্রনেতা। যারা বর্তমানে মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। গত কিছু দিন থেকে আগামী সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে এ প্রতিযোগিতা। মনোনয়ন প্রাপ্তির এ প্রতিযোগিতা চলছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ চার নেতাদের মধ্যে। নেপথ্যে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়রের টিকিট পেতে কে কার আগে যাবেন-এমন পেরেশানিতেই ব্যস্ত তারা।

মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে যতটুকু আশাবাদী কামরান-আরিফ তাদের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা আসাদ উদ্দিন আহমদ এবং মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, সাবেক ছাত্রনেতা বদরুজ্জামান সেলিম। শুধু যে তারা আত্মবিশ্বাসী এমন নয়, তারা এখন রীতিমতো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, সিলেট পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার হিসেবে জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। এরপর নির্বাচিত হন পৌর চেয়ারম্যান। ২০০২ সালে সিলেট পৌরসভা উন্নীত হয় সিটি কর্পোরেশনে। সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনেও নগরবাসী আস্থা রাখেন তার প্রতি। সিলেট সিটির প্রথম নগরপিতা হিসেবে অভিষিক্ত হন কামরান। ২০০৮ সালে সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনেও ভোট বিপ্লব ঘটিয়ে কারারুদ্ধ কামরান পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন।

বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তৃণমূল থেকে ওঠে আসা কামরানের সামনে ছিল হ্যাটট্রিক মেয়র হওয়ার সুযোগ। কিন্তু ঘটে ছন্দপতন। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হার মানতে হয় তাকে। নগর ভবন ঠিকানা না হলেও সিলেট মহানগরের অনেক মানুষ এখনও তাকে ‘মেয়র সাব’ বলেই সম্বোধন করেন।

তবে নিজ দল এবং তৃণমূলে পরিবর্তনের স্লোগান বইতে শুরু করলে কামরানের সামনে বাধা নিজ দলের নেতা আসাদ উদ্দিন আহমদ। ‘পরিচ্ছন্ন রাজনীতির অহংকার আসাদ উদ্দিন আহমদকে মেয়র পদে দেখতে চাই।’ ‘বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন, আসাদ ভাইকে মেয়র পদে দেখতে চাই!’ নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদের ছবিসহ এ রকম ‘মেয়র দেখতে চাওয়ার’ পোস্টার শোভা পাচ্ছে সিলেট নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দেয়ালে দেয়ালে।

১৯৭৭ সালে মদনমোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন আসাদ। তৎকালীন সময়ে ৪ বার ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটে ১৯৭৮ সালে প্রথমেই খেলাধুলা সম্পাদক, ১৯৭৯ সালে ছাত্র মিলনায়তন সম্পাদক, ১৯৮০ সালে সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৮২ সালে সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছাত্রসংসদের অন্যতম নেতা হিসেবে হন ১৯ মামলার আসামি। ১৯৮৬ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৯১ সালে জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ২০০৩ সালে মহানগর গঠনের পরই মহানগর আওয়ামী লীগের ১ম যুগ্ম সম্পাদক এবং ২০১১ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আসাদ।

বিএনপি সূত্র জানায়, বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে রাজনীতিতে জড়িত। তিনি ১৯৮০ সালে সিলেট বিভাগ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেলা বিএনপির সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য, মহানগর বিএনপির সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতি করে প্রায় ১৫টি মামলা হয়।

ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে অসংখ্যবার কারাভোগ করেন আরিফ। সর্বশেষ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় টানা কারাভোগ করতে হয় তাকে। গত নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে হারিয়ে মেয়র হন তিনি।

বদরুজ্জামান সেলিমও বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে রাজনীতি করছেন। ১৯৭৮ সালে জাগো দলের কর্মী হিসেবে বিএনপিতে যোগদান করেন। ৩৮ বছরের রাজনীতিতে তিনি একাধিকবার কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন ছাড়াও জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক, দু’বারের নির্বাচিত সভাপতি, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি, জেলা ও মহানগর বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৪ সালে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হন। পরে দলের সম্মলনে তিনি মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বিপুল ভোটে।

আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমি সিলেটের মানুষকে নিয়ে কাজ করছি। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকাকে আমি ঈমানি দায়িত্ব মনে করি।

কামরান বলেন, আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে নৌকার বিজয় নিশ্চিত হয়। আমরা অতীতে এর প্রমাণ পেয়েছি। ভবিষ্যতেও প্রমাণ পাবো। আওয়ামী লীগ একটি বড় দল উল্লেখ করে তিনি বলেন, দল থেকে অনেকেই মনোনয়ন চাইতে পারেন। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম ঠিক করবে কে মনোনয়ন পাবেন।

তিনি বলেন, আমার দল আমাকে সাহস দিয়েছে। মনোনয়ন পেলে নগরবাসীর ভালোবাসা নিয়ে নগরবাসীকে নিয়েই কাজ করে যাবো। সিলেটের মানুষের ভালোবাসার কারণেই আমি আজকের কামরান। আমার বিশ্বাস আমার প্রাণের সংগঠন আমাকেই মেয়র পদে মনোনয়ন দেবে।

আগামী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নিজে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আমাকে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, দলের জন্যই আমার আজকে অবস্থান। দলের জন্য অনেক ত্যাগও স্বীকার করেছি। আমার বিশ্বাস দল আমাকে অমূল্যায়ন করবে না। সিলেটের উন্নয়ন এবং বিএনপির প্রতি আমার ভালোবাসা এবং নগরবাসীর বাসনা পূরণের জন্য আমি ফের দলীয় মনোনয়ন পাবো বলে বিশ্বাস করি।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, মানুষ এখন পরিবর্তন চাচ্ছেন। নগরের মানুষের সেই চাওয়া থেকে এবং তৃণমূল আওয়ামী লীগ সমর্থনে আমি প্রার্থী হবো।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে কাজ করার কথা বলেন। এর মানে এই নয় কাউকে মনোনয়ন দিয়ে দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস তৃণমূলের জরিপ এবং নগরীর মানুষের চাওয়ার ব্যাপার যদি আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দেয়-তাহলে অবশ্যই আমি মনোনয়ন পাবো।

মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, ১৯৯৫ সালে ছাত্র থাকাবস্থায় আমি পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন লাভ করি। তখন আমি ছাত্র ছিলাম। ওই সময় আমার প্রস্তুতি ছিল না।

তিনি বলেন, ১৯৭৮ সালে জাগো দলের কর্মী হিসেবে বিএনপিতে যোগদান করি। ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের একটি বিশাল অনুষ্ঠানে শহিদ জিয়ার সন্তান বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে দলের সদস্যপদ নবায়ন করি। এখন আমি মেয়র পদে নির্বাচন করতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। এর পেছনেও কারণ আছে। অন্যতম কারণ হচ্ছেন এই নগরের মানুষ। তাদের উৎসাহ-আর উদ্দীপনায় আমি প্রার্থী হবো।

সেলিম বলেন, আগে যে আশায় বিএনপি মেয়র প্রার্থী দিয়ে সিটি নির্বাচনে বিজয়ী করিয়েছিল সেই আশা বিএনপির পূরণ হয়নি। আমার বিশ্বাস এবার সঠিক প্রার্থী দেয়া হবে।

ছামির মাহমুদ/এমএএস/জেআইএম