ফরহাদ আহমেদ
Advertisement
বর্তমান সময়ে রাজধানী ঢাকাতে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করা অনেকটা দুঃসাধ্যের ব্যাপার। একে তো জমির আকাশ ছোঁয়া মূল্য, অন্যদিকে চাহিদামত জমি পাওয়া খুব সহজ নয়। এরকম পরিস্থিতিতে অনেকে ঝুঁকে পড়ছেন ফ্ল্যাট ক্রয়ের দিকে। অনেক ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করে সেগুলো বিক্রি করছে। এতে করে অনেকের ঢাকাতে স্থায়ী মাথা গোঁজার স্থান নিশ্চিত হচ্ছে।
মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের ছোট্ট একটি স্বপ্ন- রাজধানীর কোথাও ছোট একটি ফ্ল্যাট কেনার। পূর্বে অনেকেরই ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য থাকলেও এখন তা স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। কারণ, ঢাকায় গত চার বছরে এলাকাভেদে ফ্ল্যাটের দাম ১০ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনায় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আগের চেয়ে কম সুদে আবাসন ঋণ দিচ্ছে। এছাড়া, ক্রেতার আস্থা বাড়াতে দেশের আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মানসম্পন্ন ফ্ল্যাট ও প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। তার পরও মন্দা কাটছে না আবাসনশিল্পে।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফ্ল্যাটের দাম কিছুটা কমলেও বিক্রি বাড়েনি। ঢাকাসহ সারা দেশে দশ হাজারেরও বেশি ফ্ল্যাট অবিক্রিত অবস্থায় রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বাজারের প্রকৃত চাহিদা বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে তারা জানান। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট এন্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) বলছে, এ খাতের অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী অনভিজ্ঞ ভুঁইফোড় ব্যবসায়ীরা। তবে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আবাসন ক্রেতাদের কম সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়ায় এ খাতে সুদিন ফিরবে বলেও আশা করছে সংগঠনটি।
Advertisement
এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চার বছর কঠিন সময় পার করেছে দেশের আবাসন খাত। এতে ছোট ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান টিকতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। তবে এ অবস্থা পার করে এখন প্রকৃত আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করছে, যারা গ্রাহককে সেবা দেওয়ার মনমানসিকতা নিয়ে কাজ করছে।
ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের যৌক্তিকতা তুলে ধরে গবেষণায় আরও বলা হয়, এখন আবাসন ঋণের সুদের পরিমাণ বেশ কম। আবাসনের জন্য ঋণ পেতে সরকারও এখন সহায়ক বেশ কিছু নীতিমালা নিয়েছে। এ জন্য ফ্ল্যাট কেনার উপযুক্ত সময় এখনই। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা করা হয়েছে যা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে।
ঢাকায় ফ্ল্যাট বা প্লট ক্রয়ের জন্য ক্রেতার চাহিদার শীর্ষে আছে উত্তরা এলাকা। এর কারণ ব্যাখ্যায় বলা হয়, সুযোগ-সুবিধা অনুসারে ক্রেতা যে দামে ফ্ল্যাট কিনতে চান সেগুলোর বেশির ভাগই উত্তরায় অবস্থিত। বনানী বা ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের দাম অনেকটাই বেশি। দামের তুলনায় উত্তরায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মান বেশ ভালো। এসব কারণেই ক্রেতার পছন্দের শীর্ষে আছে উত্তরা এলাকা।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের তথ্যমতে, ঢাকাসহ সারা দেশে দশ হাজারেরও বেশি ফ্লাট অবিক্রিত অবস্থায় রয়েছে। আর এতে বড় অংকের বিনিয়োগ আটকে পড়ায় এ খাতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা বাজারের প্রকৃত চাহিদা বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
Advertisement
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে যে আবাসন ব্যবস্থা করা হয়, বিশেষ করে অ্যাপার্টমেন্ট হাউজিং, সেখানে চাহিদার চেয়ে যোগানটা বেশি হয়ে গেছে। এছাড়া, উচ্চমূল্যর ফ্ল্যাট সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
দ্রুত বর্ধনশীল আবাসন শিল্প সম্প্রসারণের একপর্যায়ে অনভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে বলে মনে করেন অনেকে। রং মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্র, টাইলস মিস্ত্রি এরা পাঁচজনে মিলে দেখা যাচ্ছে একটা রিয়েলস্টেট প্রতিষ্ঠান দিয়ে ফেলছে। সাইনিং মানি কাঠাপ্রতি দশ লক্ষ টাকা, সেখানে তারা ভূমি মালিককে বিশ লক্ষ টাকার অফার করে। কারণ, ব্যবসা সম্বন্ধে তাদের তো কোন জ্ঞানই নেই।
আবাসন খাত সম্প্রতি শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ শিল্পের কোন সুবিধাই পাচ্ছেন না তারা। আবাসন খাতের নির্মাণ ব্যয় কমাতে তাদের দাবি- অগ্নিনির্বাপক পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা, শিল্প হারে বিদ্যুৎ বিলের সুযোগ, ফ্ল্যাট নিবন্ধন ফি কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা। তবে সম্প্রতি সহজ শর্তে ঋণের সুযোগ বৃদ্ধিতে স্বস্তি প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিহ্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘হাউজ বিল্ডিং আমাদের ২৫ বছর মেয়াদী লোন দেবে বলে কথা দিয়েছে। যেখানে তাদের সুদের হার ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে এনেছে। আমরা মনে করি, এখন গ্রাহকরা হাউজিংয়ের ক্ষেত্রে লোন নিতে আগ্রহী হবে।’
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রের মাধ্যমে জানিয়েছে রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সদস্য পদ ছাড়া কোন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করতে পারবেন না। পরিপত্রের স্মারক নং-বাম/টিও-২/এ-৩/৯২ (অংশ-৩)/১২৩ তারিখ ২ মে, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ।
মূলত বাণিজ্য সংগঠন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ১৩ (১) ধারার বিধানমতে সকল ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর সদস্য পদ আবশ্যিকভাবে গ্রহণ করার বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং সদস্য পদ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছে। মূলত আবাসন খাতের স্বচ্ছতা- জবাবদিহিতা এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য এটা করা হয়েছে।
অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ক্রেতাদের সাথে অনিয়ম এবং প্রতারণা করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। যার বদনাম হয় পুরো খাতের উপর। রিহ্যাব ছাড়াও প্রায় আরো দেড় হাজার রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান আছে। তারা আমাদের সদস্য না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আসলে আমরা তা সমাধান করতে পারতাম না। সেজন্য এক ছাতার নিয়ে নিয়ে আসতে সরকারের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
ঢাকায় জনসংখ্যার তুলনায় জমির অভাব এবং দামও আশাকচুম্বী, তাই নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য আবাসন নিশ্চিতে পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলার পক্ষে মত দেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।
এইচআর/পিআর