জাতীয়

কাজ করতে পারছেন না রানা প্লাজায় আহত ৪৮ শতাংশ শ্রমিক

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ কাজ করতে পারছেন না। শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তাদের এই অবস্থা। জীবিত শ্রমিকদের অনেকের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর অনেক শ্রমিক এখনো মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।

Advertisement

মঙ্গলবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন তুলে ধরেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার নুজহাত জেবিন। এছাড়া একটি বিশ্লেষণপত্র তুলে ধরে এই উন্নয়ন সংস্থাটি। সরকার, মালিক, বিদেশি ক্রেতা, শ্রমিক সংগঠন এবং রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকসহ সবপক্ষের প্রতিনিধিরা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় জীবিত ২০০ শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে গবেষণা প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখানো হয়েছে, জীবিত শ্রমিকদের মধ্যে ১২ শতাংশের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর ২২ শতাংশ শ্রমিক এখনো মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। গবেষণায় অংশ নেয়া ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন তারা এখনো কোনো কাজ করতে পারছেন না। অন্যদিকে, ২১ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক পোশাক কারখানায় আবারও যুক্ত হতে পেরেছেন।

Advertisement

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর শ্রমিকদের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরার পাশাপাশি রানা প্লাজা দুর্ঘটনাপরবর্তী পোশাক খাতের উন্নয়নে যে সমস্ত সংস্কার ও নীতগত উদ্যোগ সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষ নিয়েছিল তারও পর্যালোচনা করা হয়।

‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের শিল্প খাত: উদ্যোগ ও পরিবর্তন’ নামক বিশ্লেষণপত্রটি উপস্থাপন করেন ডেভেলপমেন্ট সিনার্জি ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জাকির হোসেন।

এতে বিভিন্নজনের বক্তব্যে উঠে আসে। বলা হয়, ওই দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও পোশাক খাতের উন্নয়নে সরকার, মালিক ও ক্রেতারা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষ করে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়ন কার, মজুরি ও ভবন নির্মাণ বিষয়ে যথাযথ আইন ও উদ্যোগের অভাবে এখনো পোশাক খাতের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ।

ড. জাকির হোসেন বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা নানাভাবে সহযোগিতা পেয়েছেন। তবে এই ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে কোনো মানদণ্ড ঠিক করা হয়নি। নেই আইনি কাঠামোও। আবার দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার এবং বিদেশি ক্রেতারা। তবে তাদের কাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভবনের উন্নয়ন অর্থাৎ কারিগরি সংস্কার। শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে।’

Advertisement

সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছবি বিশ্বাস বলেন, ‘নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ পাওয়া, ভালো মজুরি পাওয়া শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি। মানবিক কারণে হলেও শ্রমিকদের দিকে তাকানো দরকার।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকরা প্রথমদিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দ্রুত কিছু টাকা পেয়েছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তারা।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান (অব.) বলেন, ‘সাভারের দুর্ঘটনার পরও আমাদের টনক নড়েনি। এখনো ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিধিমালা মানা হচ্ছে না। যে যার মতো করে ভবন তৈরি করছেন। আবার সাভার দুর্ঘটনার পর অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এখনো তা ভাঙা হচ্ছে না। কারখানার যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কি না তা দেখারও কেউ নেই। নেই জবাবদিহি।’

ভবনের ঝুঁকিপূর্ণতা নিয়ে বুয়েটের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, ‘সঠিকভাবে ভবন নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড তৈরি করা হয়েছিল সেই ’৯০-এর দশকে। তবে সেটি এখনো আইনে রূপান্তরিত হয়নি। ফলে মানুষ বিধিমালা মানে না। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নেয়া হয় না। সাভারের ঘটনা তার জ্বলন্ত উদাহরণ।’

ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সম্প্রতি আশুলিয়ায় শ্রমিকরা যখন তাদের অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করল, তখত তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হলো। তারা নিজের কথাগুলো বলতে পারে না। ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না শ্রমিকরা।’

ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি ড. ওয়াজেদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান করতে হলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা জোরদার করতেই হবে। শ্রমিদের ইউনিয়ন কার্যত নেই। যাও আছে শুধু লোক দেখানের জন্য।’

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যে সংস্কার ও উদ্যোগের কথা বলা হয় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষ করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। শ্রমিকরা যাতে সম্মানজনক এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরি পায়, এ জন্য সরকার, মালিক ও ক্রেতাদের দায়িত্ব নিতে হবেই। শ্রমিক অধিকারবিষয়ক যেসব আইন আছে তা প্রয়োগের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। আর যদি পরিস্থিতির পরিবর্তন না হয় তাহলে আমরা দারিদ্র্যতা থেকে বের হতে পারবো না। দূর হবে না অসমতা এবং বৈষম্য।’

এফএইচএস/জেডএ/বিএ