অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি করেছেন। বিশিষ্ট পরিবহনবিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত তিনি। গণপরিবহনের চলমান সংকট, যানজট, নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি জাগোনিউজ-এর মুখোমুখি হন এই বিশেষজ্ঞ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। জাগোনিউজ : গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলার বিষয়টি কিভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
Advertisement
ড. সামছুল হক : পেশাদারি লোক না থাকার কারণেই এমনটি হয়ে আসছে। সরকারের মধ্যে কোনো প্রস্তুতি নেই পরিবহন নিয়ে। ব্যবস্থাপনা হচ্ছে একটি বিজ্ঞান। ব্যবস্থাপনায় সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণেই বারবার ননসেন্সের (কাণ্ডজ্ঞানহীন) পরিচয় দিচ্ছে। ২০ বছর আগে সিএনজি নিয়ে নানা অভিযানে যে ব্যবস্থা দেখেছি, এখনও তাই দেখছি। ফলাফল কি হবে তা সরকারের লোকেরাও জানেন। এরপরও লোক দেখানোর জন্য এমন ঘটা করে আয়োজন করা হয়। ‘কিছু একটা করতে পারলাম’ এমন একটি ভাব দেখানোর জন্যই এই ব্যর্থ অভিযান।
জাগোনিউজ : এখানে পেশাদারি বলতে আসলে কী বোঝাতে চাইছেন? প্রস্তুতিটা কী?
ড. সামছুল হক : গোটা দুনিয়াতেই পরিবহন সেক্টরের জন্য বিশেষ জনবল থাকে। এই জনবলের অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত, ডক্টরেট করা। তারা পেশাদারিত্বের প্রশ্নেই বিশেষজ্ঞ জনবল নিয়োগ দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে এমন পেশাদার জনবল আপনি পাবেন না। পরিবহন সেক্টর নিয়ে কথা বলছেন, অথচ তিনি এই সেক্টরের কেউ নন। বিআরটিএ এবং ডিটিসিএ'তে যারা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছেন, তারা গণপরিবহনের জনবল নন। অর্থাৎ যারা এই সেক্টরের পরিকল্পনা করছেন, তদারকি করছেন এবং কথিত অভিযান পরিচালনা করছেন, তারা সবাই অপেশাদার বলেই আমি মনে করি। গণপরিবহন বিষয়টা কি? এর চরিত্র কি? এটি কার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং এর সিস্টেম বোঝার জন্য সামগ্রিক জ্ঞানসম্পন্ন জনবল থাকা দরকার সেটাই সরকার অনুধাবন করতে পারে না।
Advertisement
জাগোনিউজ : এটি কিসের ভিত্তিতে তুলনা করে বলছেন?
ড. সামছুল হক : গোটা দুনিয়ায় গণপরিবহন নিয়ে আলাদা ইউনিট রয়েছে। এর নামই হচ্ছে ‘পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ইউনিট। এই ইউনিটে শুধু একটি প্রোডাক্ট থাকে না। বাসভিত্তিক গণপরিবহন, রেলভিত্তিক গণপরিবহন এবং নৌভিত্তিক গণপরিবহন থাকে। রেলে আবার এমআরটিভিত্তিক গণপরিবহন, লাইটেন ট্রানজিটভিত্তিক গণপরিবহন, মনো রেলভিত্তিক গণপরিবহনও থাকে। এদের কোনোটিই আবার পূর্ণাঙ্গ না। এর কারণ হচ্ছে কোনো গণপরিবহনই ডোর টু ডোর সেবা দিতে পারে না। কিন্তু জনগণ চায় ডোর টু ডোর সেবা। এই চাওয়াটাই বুঝতে পারার ব্যাপার। কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে চাইবে। আর এটি করলেই নিয়ন্ত্রণ আর থাকে না। কারণ রাস্তা বাড়ানো সম্ভব না। রাস্তার কাঠামো পরিবর্তন না করে অধিক সংখ্যক মানুষকে সেবা দিতে পারাই হচ্ছে সরকারের সার্থকতা। এটি বিআরটিএ'র বুঝতে পারার কথা ছিল। রাস্তায় ছোট গাড়ি চলছে ৮৪ শতাংশ। বিআরটিএ'তে পেশাদার লোক থাকলে বলতেন সর্বনাশ হয়ে গেছে, কিছুদিন পর তো রাস্তায় আর কোনো বাস চলতেই পারবে না। এই হলে অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি কিনে ফেলবে। মানুষ সিএনজিতে উঠবে। অনেকেই মোটরসাইকেল কিনবেন। এ কারণেই বলছি, যখন যা ঘটছে, তা সামাল দেয়ার জন্য অপেশাদার লোক দিয়ে সমাধানের জোড়াতালির চেষ্টা চলছে। গণপরিবহন নামের আলাদা যদি কোনো বিভাগ থাকত তাহলে পাঁচ বছর পর রাস্তায় কি হবে, তার পরিকল্পনা তারা সাজিয়ে রাখতেন। কোনো আন্দোলনেরও দরকার পড়ত না, আবার অভিযানেরও দরকার পড়ত না। কোথায় কোন ওষুধ দিতে হবে, তা তারাই ভালো জানতেন।
জাগোনিউজ : গণপরিবহনের অনেকগুলো ধাপের কথা বললেন। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী কোনটিকে বলবেন?
ড. সামছুল হক : একটি মেগা সিটিতে বাসই একমাত্র কার্যকরী গণপরিবহন বলে মনে করা হয়। কারণ এমআরটি বলেন আর বিআরটি বলেন, এটি মেইন করিডরে চলে। কিন্তু বাস অনেকটাই কাছাকাছি জায়গায় আসতে পারে। এক সমীক্ষা বলছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ সরকার রিভাইসড এসটিপিতে যে ৭টি আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রচলন করবে, তাতে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ লাগবে। এত বড় বিনিয়োগ করার পরেও সেখানে ১৭ ভাগ সেবা থাকবে এবং বাসে থাকবে ৪০ শতাংশ। এখান থেকেই প্রতীয়মান হয় যে কোনটির গুরুত্বটা বেশি। যারা এসটিপি নিয়ে আসলেন তারাও বললেন বাসভিত্তিক যে গণপরিবহন রয়েছে সেখানে জট পাকানো রয়েছে। বাসকে আরও স্বাস্থ্যবান করার তাগিদও রয়েছে। অথচ বাসের রাস্তা রুগ্ন-সরু হয়ে পড়ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা থাকছে পরিবহন। আর রাস্তা ফাঁকা পেলেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এতেই দূর্ঘটনা বাড়ছে। যানজটই দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে।
Advertisement
জাগোনিউজ : শুধু অপেশাদার জনবলের কারণেই কি এই যানজট?
ড. সামছুল হক : আমি আপাতত তাই বলব। অপেশাদার জনবলের কারণেই এই যানজট। বিভিন্ন সেক্টর থেকে ২০ কি ২২ জন লোক ধার করে এনে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি করা হয়। সেখানে মালিক, শ্রমিক, পুলিশ, সাংবাদিকও থাকছেন। এদের কেউই গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ নন। আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। চাইলেই কমিটি রাস্তায় দশটি বাস নামানোর জন্য সুপারিশ করে থাকে।
জাগোনিউজ : প্রয়োজন, সমস্যা তো যেকোনো নাগরিকের চোখেই ধরা পড়ে। সুপারিশ করতেই পারেন?
ড. সামছুল হক : গণপরিবহন বৈজ্ঞানিক সিস্টেমের ফল। কোন রাস্তায় কোন পরিবহন থাকবে, তার মান কি হবে এগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা থাকতে হবে।গবেষণা পেপার সরকারের হাতে থাকলে বলতে পারত, কালশীতে একটি নতুন রাস্তা হয়েছে, এর জন্য দৈনিক ৫০টি বাস লাগবে। বাসের মান এমন হতে হবে, বাস অমুক জায়গায় রাখতে হবে, চালক নিয়োগে এই এই যোগ্যতা থাকতে হবে। তখন বড় বড় কোম্পানি এসে টেন্ডার ড্রপ করত। সব যোগ্যতার মাপকাঠিতে নির্ধারণ করে বাছাইকৃত কোম্পানিকে তখন বলবে, পিক আওয়ারে এই চাহিদা, অফ পিক আওয়ারে এই চাহিদা এবং কিছু জায়গা ধরে বিরতিহীন বাস নামান।
এএসএস/ওআর/এমএস