দেশজুড়ে

হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘের অস্তিত্ব

আগামীকাল বুধবার বাংলাদেশে পালিত হবে বিশ্ব বাঘ দিবস। ২০১০ সাল থেকে বাঘ টিকে আছে এমন ১৩ টি দেশে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে বেশ ঘটা করেই বাঘ দিবস পালন করা হলেও তার অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবনকে দিনের পর দিন অরক্ষিত করে ফেলায় চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে দেশের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। অথচ রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবন সংলগ্ন জেলা বাগেরহাট ,খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত সুন্দরবনে বসবাসকারী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বৃদ্ধি তো হয়নি বরং আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। সর্বশেষ  বাঘ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে বাঘের যে সংখ্যা প্রকাশিত হযেছে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সর্বশেষ ২০১৫ সালের রোববার (২৬ জুলাই) প্রকাশিত ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনার জরিপ অনুয়ায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা এখন ১০৬টি। অথচ ২০০৪ সালে বন বিভাগ এনএনডিপির সহায়তায় প্রথমবারের মতো বাঘের পায়ের ছাপ গুণে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল ৪৪০ টি। দুই বছর পর ২০০৬ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করে এর সংখ্যা নির্ধারণ করে ২০০টি। গত ১১ বছরে বাঘের সংখ্যা কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে।বাংলাদেশের বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে যে পরিমাণ বাঘই থাকুক দ্রত এর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরা শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। ১৯৮০ সাল থেকে বাঘের চামড়া সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর বিদেশে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জসংলগ্ন গ্রামগুলোয় একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মংলা, মোড়েলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়। সর্বশেষ বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ৫২টি বাঘ গ্রামবাসী, চোরা শিকারি ও বিভিন্ন ধরনের অপঘাতে মারা গেছে। এছাড়া গত দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছয়টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি চামড়াই পাওয়া গেছে গত ডিসেম্বরে সুন্দরবনের ভেতরে তেলবাহী জাহাজডুবির পর। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় অন্যতম হুমকি মানুষের তৎপরতা তথা অবৈধ শিকার। তাছাড়া খাবারের অভাব ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের ফলে সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব কমেছে। বনের ঘনত্ব ও পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে কমপক্ষে ২০০ বাঘ থাকার কথা। কিন্তু চোরা শিকারিদের বাঘ শিকার, সুন্দরবনের ভেতরের নদী দিয়ে নৌযান চলাচল এবং বনের পাশে শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ বাঘের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।    শুধুমাত্র সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে চোরা শিকারিসহ বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের ১৭টি বাঘ মারা গেছে। পরিবেশবিদদের হিসেব মতে, এর সংখ্যা ৩০টি। ২০০১ সাল থেকে ২০১২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৩০ টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ১৬ টি পূর্ব সুন্দরবনে আর ১৪ টি পশ্চিম বিভাগে মারা য়ায।  বাঘ রক্ষায় সরকার ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যায় সর্বোচ শাস্তি ১২ বছরের কারাদণ্ড ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত  হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার বিধান করেছে।  বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ সালের ২০ নভেম্বর শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী এলাকা থেকে ১ টি স্ত্রী বাঘ ও একই বছরের ১২ ডিসেম্বর চাদপাই সদর রেঞ্জ এলাকায় ১টি পুরুষ বাঘ ও ২০০৫ সালের ২৬ অক্টোবর একই রেঞ্জের বলেশ্বর নদীর পাড় সংলগ্ন বন থেকে বাধর্ক্যজনিত কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছিল। এদিকে, ২০০২ সালের ৯ সেপ্টম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া টহল ফাঁড়ি এলাকায় ১টি পুরুষ বাঘকে দুষ্কৃতকারীরা গুলি করে হত্যা করে, ২০০৩ সালের ২৮ মে চাঁদপাই রেঞ্জের নলবুনিয়া গ্রামে, ১৯ অক্টোবর শরণখোলা রেঞ্জের চালিতাবুনিয়া গ্রামে ২১ ডিসেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া গ্রামে ও ২০০৯ সালে ২ জুলাই শরণখোলা রেঞ্জের রাজাপুর গ্রামে লোকালয়ে ঢুকে পড়লে গণপিটুনিতে মারা যায় ৪ টি  বাঘ। এছাড়া ২০০৮ সালের ২৫ আগষ্ট শরণখোলা রেঞ্জের কাঠালতলার বেলায়েত হোসেনের বাড়ি থেকে ১ টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়। ২০০৬ সালের ২ নভেম্বর শরণখোলা এলাকার নুরুজ্জামানের বাড়ি থেকে ১ টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়, ২০০৭ সালের ২ মে চাঁদপাই রেঞ্জের হাড়বাড়িয়া টহল ফাঁড়ির পুকুর পাড় থেকে ১ টি মৃত বাঘ উদ্ধার করা হয় ও ১৬ নভেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারী স্টেশনের ঘাঘরামারী ক্যাম্প এলাকা থেকে ১ টি সিডরের আঘাতে মারা যাওয়া বাঘকে উদ্ধার করা হয়।শওকত আলী বাবু/এসএস/আরআইপি

Advertisement