মতামত

রাষ্ট্র মামাবাড়ি আর সরকার মামা-মামী নয়

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমাদের প্রথম ও প্রধান চাহিদা হয়েছে, রাষ্ট্র আমাদের কী দিচ্ছে, কিন্তু আমরা এ প্রশ্নটি নিয়ে খুউব কমই আলোচনা করি যে, রাষ্ট্রটিকে আমরা কী দিচ্ছি। চলমান কোটা-আন্দোলন নিয়ে এই প্রশ্নটিই নতুন করে ও নতুন মাত্রায় তোলার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে আমাদের।

Advertisement

কোটা আন্দোলনের একটি সমাপ্তি ঘটার কথা ছিল সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণা দেওয়ার পর। কিন্তু কার্যতঃ দেখা গেলো যে, কোটা আন্দোলনটিকে নতুন করে রাজপথে নামিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ভিসির বাসভবনে হামলার কারণে দায়ের করা মামলা তুলে নেওয়ার দাবি ও দাবি না মানলে নতুন করে আন্দোলনে নামার যে হুমকি সেটা কেবল দেশের আইন-আদালাতের প্রতি অবজ্ঞাই নয়, বরং রাষ্ট্রকে সরাসরি চ্যালেঞ্জও বটে।

কিন্তু কোটা আন্দোলনকারীদের এই বক্তব্য গণমাধ্যমে জানিয়ে দেওয়ার পর পরই আন্দোলনকারী ছাত্র নেতাদের মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার যে ঘটনা ঘটেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত দিয়ে সেটাও কেবল নিন্দনীয় নয়, বরং গর্হিত অপরাধ। রাষ্ট্র এই জায়গায় তার ভূমিকাটি পালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যে ব্যর্থতার কারণে আজকে এই প্রশ্নটিও দ্বিতীয় সারিতে নেমে যাচ্ছে যে, কেন আন্দোলনকারীরা মামলা তুলে নেওয়া না হলে নতুন করে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে? কেন তারা মামলাটি মোকাবিলার চেয়ে রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার দাবি করে যাচ্ছে? বাংলাদেশতো কোনো দখল করা রাষ্ট্র নয় যে, দখলদারদেরকে হুমকি/ধামকি দিতে হবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও কার্যকর (ব্যর্থ নয়) রাষ্ট্র, তাকে হুমকি দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি?

অপরদিকে সরকার-প্রধান কোটা আন্দোলনকারীদের দাবিটি মেনে নিয়েছেন এবং এ নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রথম থেকেই তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বার বার তার এই পদক্ষেপকে অগ্রাহ্য করে এই আন্দোলনকে আরো কী করে জোরদার করা যায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এসব চেষ্টার ক্ষেত্রে তাদের সকল পদক্ষেপই যে নৈতিক বা সমর্থনযোগ্য তাতো নয়ই, বরং প্রতিদিন স্পষ্ট হচ্ছে যে, কোটা আন্দোলনকে একটি কঠোর রাজনৈতিক তথা সরকার-বিরোধী আন্দোলনে কী ভাবে নিয়ে যাওয়া যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা।

Advertisement

এরকম রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্র বা সুযোগ যে আন্দোলন তৈরি করে দেয় সে আন্দোলনকে নিয়ে সরকারের অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হওয়ারও যে যৌক্তিকতা তৈরি হয় সেটি আমরা ভুলে যাই। আমরা সরকারের মন্ত্রী বা নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্যে এই স্পর্শকাতরতার প্রমাণ পাই কিন্তু বাংলাদেশে কেবল নয় পৃথিবীর যে কোনো দেশেই এরকম হঠাৎ তৈরি হওয়া আন্দোলন ও তার ফলে সৃষ্টি জনদুর্ভোগ মোকাবিলায় সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও অতি-তৎপর হতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে সেসব দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের চোখ বেঁধে নিয়ে যায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে কিন্তু আন্দোলনকারীদের হঠাৎ-হওয়া নেতাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না, এই প্রশ্ন নিয়ে দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি বেতালা হয়ে উঠেছেন এবং দেশের বিখ্যাত সংবাদপত্র প্রথম পাতার শিরোনাম দিয়ে এই আন্দোলনকে আরো উত্তাল করে তোলার যে ঔদাত্য আহ্বান জানিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে এই আন্দোলনকে আরো বেশি রাজনৈতিক করে তোলার পেছনে তাদের নিশ্চিত বড় ধরনের স্বার্থ রয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, যতোই সময় গড়াচ্ছে ততোই এই আন্দোলনের নানা কোণ্, রঙ ও রূপ প্রকাশিত হয়ে উঠছে মানুষের সামনে এবং তা যে খুব একটা সুখকর তাও নয়। আরো বড় কথা হচ্ছে, যতোই এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের বিষয়টি মানুষের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে ততোই মানুষ এই আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে যখন এটাই প্রমাণিত হতে চলেছে যে, আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে ছাত্রশিবিরের কর্মী ও সমর্থকরা নিজেদের রাজনীতিকেই এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করতে চাইছে তখন সে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ নিশ্চয়ই বহুবার ভাববে।

একটি ছোট্ট উদাহরণ দেই। এক সাংবাদিক বন্ধু যিনি মূলতঃ ও কার্যতঃ সরকারের সমালোচনা করেন এবং কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের কোনো ভালো কিছু খুঁজে পান না, তিনি এই কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছাত্রলীগের তুমুল সমালোচনা করেছেন এ যাবত, সেই তিনিই একাত্তর টেলিভিশনে কোটা আন্দোলনের যুগ্ম -আহ্বায়ক মোহম্মদ রাশেদ খান-এর একটি সাক্ষাৎকার ও সেখানে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে স্পষ্ট করতে না-পারা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

Advertisement

দুঃখজনক সত্য হলো, তার এই ক্ষোভের জবাবে শ’য়ে শ’য়ে তারই সপক্ষীয়গণ তাকে যেভাবে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে, এই আন্দোলন আসলে যতোটা না মেধাবীদের তার চেয়ে অনেক বেশি আসলে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার এবং সেটা অত্যন্ত কদর্যভাবেই। আবার একথা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যে, তারা কোনো ধরনের সমালোচনাই যে গ্রহণ করতে পারেন না এবং চরম অসহিষ্ণু হয়ে সমালোচকদের ব্যক্তি-আক্রমণ করেন কিংবা প্রায়শঃই শারীরিক ভাবে আঘাত করার হুমকি দেন সেটাও এদেশে আমরা দেখেছি। কিন্তু আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সাংবাদিক বন্ধুটিকে যে ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে সেটি নিতান্তই দুঃখজনক। তিনি শেষাবধি বাধ্য হয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ বেঁধে আন্দোলনকারীদের তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে লিখতে, তিনি এমনিতেই হয়তো লিখতেন কিন্তু এতো অশ্রাব্য গালাগাল শোনার পর তার এই বক্তব্যকে বাধ্যতামূলক বলেই মনে হয়েছে।

শুরুতেই বলেছি যে, বাংলাদেশকে আমরা আসলে এমন একটি দেশ হিসেবে ভেবে থাকি যে, এই দেশ থেকে কিছু পাওয়াটাই মুখ্য, একে দেয়ার কিছুই আসলে নেই। নাহলে যারা দেশটাকে স্বাধীন করলো একটি সশস্ত্র যুদ্ধে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে তারা কী করে মাত্র চার বছরের মাথায় অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ে রাষ্ট্রের কাছে? কী করে দীর্ঘকাল তাদেরকে উপেক্ষা আর অবহেলার শিকার হতে হয়? আবার যখন তাদেরকে সামান্য সম্মান দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয় তখনই তাদেরকে সে সুযোগ কেন দেওয়া হলো তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে?

ভুল আর অসংলগ্ন তথ্য দিয়ে একটি তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে যখন দেশটির বুদ্ধিমান ও বয়স্ক প্রজন্ম রাজনৈতিক খেলায় নামেন তখন তাদের রাজনীতি, দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ নিয়েই যে প্রশ্ন তৈরি হয় সেটা আমরা ভুলে যাই প্রায়শঃই। এমনকি কোটা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ এই প্রশ্নটাও যৌক্তিক করে তোলে যে, আন্দোলনকারী নারীরা কি সত্যিই এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, কেন এবং কোন্ উদ্দেশ্যে এই আন্দোলন তারা করছেন? তাদের প্রাপ্যটাই আসলে কী হবে আন্দোলন শেষে?

যাদের নেতৃত্বে তারা আন্দোলন করছেন সেই পুরুষ নেতৃত্বই যখন প্রকাশ্যে নারীদের রাজপথে নামার সমালোচনা করেন ভিন্ন কোনো আন্দোলন প্রসঙ্গে তখন বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে, আন্দোলন-ভেদে আসলে রাজনৈতিক অবস্থান বদলানো এই পুরুষ নেতৃত্ব নারীর প্রকৃত উন্নয়ন চান না। তিনি এক্ষেত্রে নারীদের ব্যবহার করেছেন মাত্র।

সর্বশেষ, যে যৌক্তিক প্রশ্নটি এখন এই কোটা-আন্দোলনকে প্রায় অযৌক্তিক করে তুলছে তাহলো, একটি আন্দোলনকে অশান্ত ও হিংসাত্মক ঘটনায় পর্যবসিত করায় যারা ভূমিকা রেখেছিল তাদেরকে কেন আইনের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানাচ্ছে আন্দোলনকারীরা? কেন তারা আইনী প্রক্রিয়াতেই সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো বে-আইনী আচরণ বা পদক্ষেপকে মোকাবিলা করার সাহস পাচ্ছে না?

সৎ সাহসটুকু না থাকলে এই মেধার পরিণতি তবে কী হবে? এদেশের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা কেমন সেটা ব্যক্তি মাত্রেই জানেন। মেধার কারণে তারা সুযোগ পেয়ে নাগরিককে কী ভাবে হয়রানি করা যায় সে পথ খুঁজতে খুঁজতে আর প্রয়োগেই সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন ক্রমশঃ। নিজেদেরকে ‘কিং মেকার’ ভাববার এই প্রবণতা এখন আরো বেড়েছে কারণ সরকার তাদেরকে আরো সুবিধাদি দিয়ে নতুনদেরকেও সরকারী চাকুরিতে বেশি আগ্রহী করে তুলেছে মূলতঃ কোটা আন্দোলন এই সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার আগ্রহ থেকেই। সেটাতে দোষ নেই কোনো কিন্তু রাষ্ট্রকে এভাবে অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য হুমকি দেওয়া হলে যে কারোরই এটা মনে হতে পারে যে, তার মানে কি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আমাদের সকলের ‘মামাবাড়ি’ আর সরকার হলো ‘মামা কিংবা মামী’, এই মামাবাড়ির কাছে যে কোনো দাবি জানানো যায় এবং মামা-মামী সেগুলো পূরণে কার্যত বাধ্য?

আজকালতো এমন মামাবাড়ি বা মামা/মামীর দেখা পাওয়াও মুশকিল যেখানে ‘যা চাই তাই-ই পাওয়া যায়’, তবে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এমন হবে কেন? রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন, আইন-আদালতকে চ্যালেঞ্জ জানানো যেতে পারে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিন্তু সেগুলোকে সরাসরি উপেক্ষা করে হুমকি-ধামকি প্রয়োগ কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

ঢাকা ১৭ এপ্রিল, মঙ্গলবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/পিআর