গত বছর যখন ঢাকা এসেছিলেন, দেখা করতে গিয়েছিলাম তার সোনারগাঁও হোটেলের স্যুটে। ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা বললেন, স্যার কিন্তু সময়ের ব্যাপারে খুব সচেতন, আপনি দেরি করতে পারবেন না। দেরি কি করি? দেখা হবে, ভারতরত্ন, সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের সাথে। তাই আগে ভাগেই যাওয়া, দেখা করা, কথা বলা। হাস্যোজ্জ্বল এপিজে কালাম বলছিলেন অবসর নেয়ার পর থেকে তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ স্কুল–কলেজের ছেলেমেয়েদের সামনে কথা বলতে পারা। তাদের শেখাতে, বোঝাতে, স্বপ্ন দেখাতে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে নতুন চিন্তাভাবনার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। এবং প্রিয় সেই কাজটি করতে করতেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, এ উপমহাদেশের অন্যতম বিশিষ্টজন ড. এ পি জে আবদুল কালাম। সোমবার রাতে শিলংয়ের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে দিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হন ৮৩ বছরের ড. কালাম। মঞ্চের ওপরেই অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় শিলংয়ের বেথানি হাসপাতালে। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আজীবনের বিজ্ঞানসাধক হয়ে উঠেছিলেন ভারতসহ বহুদেশের তরুণ-তরুণীর কাছে স্বপ্নসাধক। যিনি বলতেন, “স্বপ্নতো তা নয় যা ঘুমের মধ্যে আসে, তাই স্বপ্ন যা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তুমি ঘুমাবেনা”। পরিচিতি পেয়েছিলেন ভারতের মিসাইলম্যান হিসেবে। দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নতি ও আধুনিকীকরণে তাঁর অবদান ছিল সবার থেকে বেশি। ১৯৯৮ সালে পোখরানে ভারতের দ্বিতীয় পরীক্ষামূলক পরমাণু বিষ্ফোরণ সফল করার মূল দায়িত্ব ছিল তাঁরই হাতে। তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে প্রথমে পদ্মভূষণ, তারপর ভারতরত্ন খেতাব পান তিনি। ২০০২ সালে দেশের একাদশতম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, সর্বসম্মতির ভিত্তিতে। ২০০২ থেকে ২০০৭, এই পাঁচ বছরের কার্যকালে এমন বহু উদ্যোগ এবং সক্রিয়তা দেখিয়েছেন তিনি, যা রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিরল। তাঁর উৎসাহেই প্রথম ভারতের নাগরিকরা সরাসরি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ই-মেলে যোগাযোগ করতে শুরু করেন, যেসব চিঠির জবাব নিজেই দিতেন রাষ্ট্রপতি। মিসাইল, কিংবা মহাকাশ গবেষণার জন্য শুধু নন, এপিজে মানুষের মনে চিরদিন জাগরুক থাকবেন তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘উইংস অব ফায়ার’, ‘ইগনিটেড মাইন্ড’ বা ‘ইন্ডিয়া ২০২০’ বইগুলোর জন্য, যা মানুষকে মানবিক স্বপ্ন দেখাতে উদ্বুদ্ধ করছে। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের তারুণ্যের কাছে ড. কালাম এক রোল মডেল। ২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এপিজে। রাষ্ট্রপতি ভবনে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আবার ফিরে যান লেখাপড়ার জগতে। দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন, কিন্তু পরিবারের ছিলনা ধর্মের গোঁড়ামি। তাই শিশুকাল থেকেই মুক্তমনা ছিলেন আব্দুল কালাম। সবসময় যে কথাটি সবাইকে বলতেন তাহলো লেখাপড়ার কোনও বিকল্প হয় না। স্কুলপড়ুয়াদেরও বারবার অনুপ্রাণিত করে বলেছেন, নিজের ভবিষ্যতের কারিগর হতে গেলে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। আর কখনও কাজে ফাঁকি দেবে না। নিজের জীবনেও এ কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছেন। কর্মজীবনে ঠিক দু’দিন ছুটি নিয়েছিলেন, মায়ের আর বাবার মৃত্যুদিনে।ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, তিনি ছিলেন গণ মানুষের রাষ্ট্রপতি। ভারতের গণমাধ্যম বলছে ড. এ পি জে আবদুল কালামের আগে ১০জন রাষ্ট্রপতি এসেছেন, ভবিষ্যতে আরও আসবেন। কিন্তু তাঁর মতো মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, উদ্যমী এবং শিশুর সারল্যে ভরপুর, লোকপ্রিয় রাষ্ট্রপতি সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি হবে না। সরল মানুষ ছিলেন, কিন্তু আগুন ছিল, বিদ্যার আগুন ছিল তার ভেতর। তার নিজের জীবন নিয়ে লেখা বইয়ের নাম ছিল উইংস ‘অব ফায়ার।’ সত্যি তিনি ছিলেন এক আগুণের পাখা। এইচআর/এমএস
Advertisement