আত্মসমালোচনা ভালো, তবে আত্মঘাত ভালো কিছু নয়, মন্দ। নেহাত মন্দ। আত্মঘাত থেকে উত্তরণের সুযোগ থাকে না, আত্মসমালোচনা থেকে সুযোগ থাকে উত্তরণের, উন্নতির, প্রগতির। কখনও কখনও আমরা নিজের সমালোচনা করতে গিয়ে, আত্মঘাতী হয়ে উঠি।
Advertisement
এই হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করে অনেক কারণ। কখনও হতাশা, কখনওবা অধিক প্রত্যাশা। হিসাব মেলে না। হিসাবটা মেলাতেও চাই না অনেকে। চারপাশ বুঝি না, পরিবেশ প্রতিবেশ বুঝি না। এক বাস্তবতায় বাস করে, অন্য বাস্তবতার প্রয়াস খুঁজি। যে কোন মন্তব্য করে বসি অবলীলায়, নির্দ্বিধায়।
বাংলাদেশ। প্রিয় বাংলাদেশ। সূচকে যত যাই দেখানো হোক, বলা হোক, প্রচার করা হোক- খুব এগিয়ে গিয়েছি। আসলে এতটা যাইনি, যেতে পারিনি, যতটা প্রত্যাশা আমাদের। তবে প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি কি সমান মেলে সবসময়? প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ফারাক তো থাকেই, থাকবেই।
নারীদের প্রসঙ্গ এলে, কেউ কেউ বলতে শুনি, দেশে নারীদের কোন স্বাধীনতা নেই, অধিকার নেই, নিরাপত্তা নেই। একেবারে কিছুই যদি না থাকে, তো এত নারী এখানে কাজ করছে কী করে? এখন আর এমন কোনও শ্রেণি পেশা নেই, নারী নেই যেখানে। গার্মেন্টের মেয়েরা অনেক বেশি সম্মানিত, যাদের কাজের সঙ্গে, উৎপাদনের সঙ্গে, উপার্জনের সঙ্গে যোগ রয়েছে।
Advertisement
এরা অনেক বেশি সম্মানিত মানুষ। যারা নিজেদের খুব চট করে বিকিয়ে দেয় না সস্তা কিছুর কাছে, জীবনের সংগ্রামটি করে যায়, নিজের যোগ্যতা অনুসারে।
বাংলাদেশ ও ভারত পাশাপাশি দু’দেশ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ভৌগোলিক দূরত্ব থাকলেও দু’দেশের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনেক মিলও রয়েছে। অনেকেই ভারতের উদারতার, গণতান্ত্রিক চর্চার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু এত যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত, সেখানে নারীদের অবস্থা কী?
অনেকেই বাইরে থেকে অনেক কিছু দেখে আনন্দিত, উচ্ছসিত। বাইরে থেকে কোন কিছুকে দেখতে বড় মনে হলেই যে তা ভেতরে বড় তা নয় কিন্তু। কখনও কখনও ভেতর ফাপা। ভারতে নারীদের অবস্থাও তেমনই। শুনলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন, বিশ্বাস করবেন না, ভারতে প্রতি ১৪ মিনিটে একজন নারী বা নারী শিশু ধর্ষণের শিকার হন।
মনে হতে পারে, সেখানে তো মেয়েরা বাসে ট্রামে দিব্বি চড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। নারীর অবাধ, নিরাপদ বিচরণ! বছর কয়েক আগে, একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতিত হয় এমন দেশগুলোর তালিকায় প্রথমে আফ্রিকার কঙ্গো, সোমালিয়া, তারপরই রয়েছে ভারতের নাম। ভারতে নারী শিশু নির্যাতনের যে ভয়াবহ চিত্রটি অদৃশ্য বা গোপন তা হলো ‘ভ্রূণ হত্যা’।
Advertisement
মাতৃগর্ভে কন্যা শিশু দেখলেই অ্যাবরশন বা ‘ভ্রূণ হত্যা’ করা হয়। এই ভ্রূণ হত্যাকে বলা হয় ‘ফিটিসাইড’। কন্যা ভ্রূণ বা ‘ফিমেল ফিটিসাইড’ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে রীতিমত মহামারীর মতো ছিল। প্রশাসন ও আইনের কঠোর হস্তক্ষেপে কিছুটা কমেছে তার প্রকোপ।
একটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, গণমাধ্যম আত্মহত্যার খবর ক্রমাগত প্রচার করায়, প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল কোন একটি অঞ্চলে। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও তাই। ভারতের প্রায় এমন কোন হিন্দি ছবি নেই যেখানে ধর্ষণ আর ধর্ষণকারী নেই। কোন কোন ছবি তো শুরুই হয় ধর্ষণ, হত্যার প্রতিবাদের শপথ নিয়ে।
বাংলাদেশের একটি সেমিনারে, দেখা হয়েছিল ভারতের খ্যাতিমান মানবাধিকারকর্মী কমলা ভাসিনের সঙ্গে। জানতে চেয়েছিলাম, তোমার দেশের গণমাধ্যম কি কোনভাবে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণকে প্রভাবিত করছে না, অতি প্রদশর্নের মধ্য দিয়ে? কমলা ভাসিন একমত হয়ে ছিলেন আমার সঙ্গে। বলেছিলেন, শুধু প্রভাবিতই করছে না, বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
ভারতীয় মিডিয়া এত পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে যে তুমি মেয়েগুলো আর ছেলেগুলোর দিকে তাকালেই তা বুঝতে পারো। লুঙ্গি উচিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করে ‘লুঙ্গি ড্যান্স’ বা ‘বেত্তমিজ দিল মানে না, মানে না’- এক অর্থে তো পুরুষতান্ত্রিকতাকেই উস্কে দেয়।
এত বীভৎস ও বিচিত্র রকমের ধর্ষণ ভারতীয় মিডিয়ায় দেখানো হয়, যা রীতিমত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সেখানকার মন ও সমাজে। ভুলে যাননি নিশ্চয়ই, দিল্লীর বাসে তরুণীকে গণধর্ষণ। সারা ভারতজুড়ে আন্দোলন চলছে এরই মধ্যে আবারও ধর্ষণ।
মেয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধা রেহাই নেই কারো। লক্ষ্য করলে দেখবেন, ভারতীয় বিনোদন তারকারা, প্রায়ই তাদের যৌন হয়রানি আর ধর্ষিতা হবার স্মৃতিচারণ করেন। খবর হয় সেসব, তোলপাড় হয় মিডিয়া। বাংলাদেশের ক’জন তারকার- শৈশব, কৈশোর বা যৌবনে অমন ধর্ষণের খবর শুনেছেন?
ভারতজুড়ে আবারও ধর্ষণের ঘটনা তোলপাড়। ৮ বছরের মেয়ে আসিফাকে সাতজন মিলে, সাতদিন ধরে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষকদের একজন মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণকারী, সাঞ্জি রাম। তার সঙ্গীরা, সঙ্গে পুলিশও ছিল। আর অন্যদিকে, উন্নাও-এ ১৮ বছরের মেয়েকে এক বিধায়ক ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। দু’জায়গাতেই ধর্ষিতা প্রান্তিক, দলিত, দুর্বল, অসহায়।
আমরা অনেকেই হিন্দি, তামিল, তেলেঙ্গু, নায়িকাদের খোলামেলা নর্দন কুর্দন দেখে মনে করি, ওখানকার মেয়েরা অনেক স্বাধীন। পত্রপত্রিকায় ছোট খাটো পোশাকের ছবি দেখে, আর উত্তেজক সাক্ষাৎকার পড়ে ভাবি, সেখানকার মেয়েরা ভালো আছে।
আসলে তা নয় কিন্তু। বরং এই যে, আধনেংটো হওয়া, প্রায় উদোম হয়ে থাকা তা তো পুরুষতন্ত্রের কারণেই। এতে যে মেয়েরা ভালো আছে তা নয়, বরং ভালো যে নেই তাই প্রমাণ হয়। ভালো যদি থাকতো তবে আধনেংটো, উদোম হয়ে থাকতে হতো না। পুরুষের যৌন উপাচার, বিকারের উপকরণ না হয়ে, নিজের মতো স্বাধীন হয়ে থাকতে পারতো। বাঁচতে পারতো।
সেদিক থেকে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের অধিকার, স্বাধীনতা, অবস্থা ঢের ভালো। আর যাই হোক, এখানে প্রতি ১৪ মিনিটে কাউকে ধর্ষিত হতে হয় না। ভারত উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানছি, কিন্তু একটি বিশাল রাষ্ট্রের নারীরা এভাবে যৌন নির্যাতিত হলে, ধর্ষিত হলে, গণতন্ত্রের কীইবা থাকে কেবল পুরুষতন্ত্র ছাড়া!
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/আরআইপি