ধর্ম

সালানা ওরছে গাউছুল আজম মাহফিলে মুসল্লিদের ঢল

চট্টগ্রাম কাগতিয়া আলীয়া গাউছুল আজম দরবার শরীফে অনুষ্ঠিত কাগতিয়া দরবারের প্রতিষ্ঠাতা খলিলুল্লাহ আওলাদে মোস্তফা খলিফায়ে রাসূল হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর স্মরণে ৬৫তম পবিত্র মি'রাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিল ও সালানা ওরছে হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু উপলক্ষে ঈছালে ছাওয়াব মাহফিলে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ঢল নেমেছে।

Advertisement

কাগতিয়া দরবার শরীফে শনিবার বাদে নামাজে ফজর থেকেই টুপি ও তসবিহ হাতে কেউবা পায়ে হেটে, আবার কেউবা গাড়িযোগে দলে দলে আসতে শুরু করে এ মনীষীর লাখো অনুসারী, ভক্ত, হাজার হাজার আলেম, হাফেজ, যুবক, এলাকাবাসী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ধর্মপারায়ণ মুসলমাদের উপস্থিতিতে কাগতিয়া শরীফ-সহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে।

এদিন ফজরের নামাজের পর খতম শরীফ, মোরাকাবা, ঈছালে ছাওয়াব, রওজা জিয়ারত, মিলাদ-কিয়াম ও মুনাজাতের পর খতমে কুরআন ও বুখারী শরীফের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ওরছের কর্মসূচি। গত বছরের ন্যায় এ বছরও কাগতিয়া দরবার থেকে পূর্বেই ঘোষণা হয়েছিল ওরছে কারোর কাছ থেকে গরু, মহিষ, ছাগল, টাকা, নজর-নেওয়াজ ইত্যাদি কোন কিছুই নেয়া হবে না, চলবে না শরীয়ত পরিপন্থী কোন কার্যকলাপ, শুধুমাত্র কোরআন-সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণে পালিত হবে এ মহামনীষীর সালানা ওরছ।

তাই কাগতিয়া দরবারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছিল কোরআন-সুন্নাহ আলোকে একটানা দিন-রাতব্যাপী ইবাদত-বন্দেগী, খতমে কুরআন, খতমে বুখারী, মিলাদ-কিয়াম, জিকির-এলাহী, নির্দিষ্ট তরতীবে নবীর শানে দরুদপাঠসহ নানান কর্মসূচী। আলোকসজ্জিত করা হয় রওজা পাক, মসজিদসহ পুরো দরবার শরীফ। সপ্তাহজুড়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় উত্তোলণ করা হয়েছিল তোরণ এবং বিভিন্ন ভবন ও আইল্যান্ডগুলোতে শোভা পাচ্ছিল কুরআন-হাদিস ও গাউছুল আজমের বাণী সম্বলিত ফেস্টুন ও ব্যানার।

Advertisement

প্রথমে জিয়ারত করে কুরআন তিলাওয়াত ও তাহলিল আদায় করতে থাকেন হাফেজ ও সাধারণ মুসলমানরা আর আলেমরা আদায় করতে থাকেন খতমে বুখারী। ছোট শিশুরাও বসে নেই, তারাও দলবেঁধে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করতে থাকে। কোথাও নেই ওরছের নামে সেই চিরাচরিত গরু-মহিষের দৌড়াদোড়ি, রশিদমূলে টাকা উত্তোলন, ঢাক-ঢোল কিংবা বাদ্য-বাজনা। অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে সবার মুখে মুখে শুধু উচ্চারিত হচ্ছে সুমধুর সুরে কুরআন তিলাওয়াত, তাহলিল ও নিম্নস্বরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ জিকির এবং নবী (দঃ)’র শানে দরুদ পাঠ। এ যেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, প্রশান্তিময় পরিবেশ।

শুধু দেশের নয়, সপ্তাহজুড়ে বাংলাদেশে আসা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মধ্যপ্রাচ্য, সৌদিআরব, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কাগতিয়া দরবারের অনুসারী অংশ নেয়। জোহরের পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে এ কার্যক্রম। বিদেশে অবস্থানরত এ মনীষীর অনুসারীরাও বাদ পড়েননি, তারাও এদিন স্ব স্ব স্থানে বসে আর মহিলারা নিজেদের ঘরে বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকেন।

জোহরের পর রওজা জিয়ারত শেষে শুরু হয় পবিত্র মি'রাজুন্নবী (দঃ) ও গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর জীবনী শীর্ষক আলোচনা। এ সময় অশ্রুসিক্ত চোখে বক্তারা যখন এ মনীষীর নানা স্মৃতি, নসিহত স্মৃতিচারণ করছিলেন তখন কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। অনেককেই অঝোরধারায় কাঁদতে দেখা যায়। এতে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সহ-সভাপতি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আবুল মনছুর, মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশ ওলামা পরিষদের সভাপতি হযরতুলহাজ আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম হানফী, সচিব হযরতুলহাজ আল্লামা মুফতি কাজী মুহাম্মদ আনোয়ারুল আলম ছিদ্দিকী, সহ-এশায়াত সম্পাদক হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মুহাম্মদ এমদাদুল হক মুনিরী, কাগতিয়া এশাতুল উলুম কামিল এম এ মাদরাসার মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মদ আশেকুর রহমান, আল্লামা মুহাম্মদ সেকান্দর আলী, মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল হক প্রমুখ।

বাদে আসর ফয়জে কোরআন, বাদে মাগরিব তাওয়াজ্জুহর মাধ্যমে নূরে মুহাম্মাদী বিতরণ, মোরাকাবা ও তাবাররুক বিতরণের পর এশার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে হামদ, নাতে মোস্তফা ও জিকিরে গাউছুল আজম। পরিবেশন করেন মুনিরীয়া যুব তবলীগের কেন্দ্রীয় হামদ-নাত পরিষদের সদস্যরা।

Advertisement

বাদে এশা এ মহানীষীর একমাত্র খলিফা, মহান মোর্শেদ আওলাদে রাসূল হযরতুলহাজ আল্লামা অধ্যক্ষ শায়খ ছৈয়্যদ মোর্শেদে আজম মাদ্দাজিল্লুহুল আলী ছাহেব বক্তব্য রাখেন। এ সময় মসজিদের বিশাল মাঠসহ পুরো দরবার শরীফ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কোথাও তিলধারণের কোনো জায়গা ছিল না।

বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রিয়নবী (দঃ)’র সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেযা মি'রাজের অত্যাশ্চর্য ঘটনা সমগ্র মানবজাতির জন্য অতি বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। চৌদ্দশত বছর পরে এসে ১৪৩৭ হিজরির ২৬ রজব মি'রাজুন্নবী (দঃ)’র এমন বরকতময় সময়ে সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে প্রিয়নবীর সাথে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান কালজয়ী মহান মনীষী হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু। যিনি ছিলেন অবিস্মরণীয় কর্ম-কীতিতে হিদায়াতের এক উজ্জল আলোকবর্তিকা, যার কথা মানুষ কখনো ভুলবে না।

ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ মহামনীষী। গাউছুল আজমের নানান অলৌকিকতার কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, এ মনীষীর পুরো জীবনটাই ছিল অলৌকিকতায় পূর্ণ। জানাজার পূর্বে তার কফিন মোবারকের মাথা বরাবর নিচের পাথরের ঢালাইকৃত ছাদ মোমের মতো গলে মৌচাক সদৃশ্য হয়ে সুঘ্রাণ বের হওয়া, রওজার পাশে উদ্ভিদে অলৌকিকভাবে আল্লাহু শব্দখচিত নকশা অঙ্কিত হওয়া, রওজার দিকে বৃক্ষরাজির অবনত হয়ে ঝুঁকে পড়া নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে এ মনীষীর আল্লাহ ও নবীপ্রেম। দূরদর্শী আধ্যাত্মিক এ দার্শনিক এক বিরাট পরিবর্তন এনেছিলেন অগণিত যুব সমাজের মননে ও হৃদয়ে, তাদেরকে নূরে মুহাম্মদীর আলোয় শান্তি ও কল্যাণের পথ দেখিয়েছেন। এ মনীষী চিরদিনের জন্য চলে গেলেও রেখে গেছেন তাঁর অনুপম আদর্শ, তরিক্বত, কাগতিয়া দরবার, মাদরাসা ও হিলফুল ফুযুলের আদলে গড়া সংগঠন মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশ। যা কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম মিল্লাতকে হিদায়াতের পথ দেখাবে, কুরআন-সুন্নাহ আমলে জীবন গড়তে প্রেরণা যোগাবে।

পরে মিলাদ, কিয়াম ও মুনাজাত শেষে দরুদে মোস্তফা, তাহাজ্জুদ, জিকিরে জলি আদায় করা হয়। এদিন সারা রাত দূর-দূরান্ত থেকে জিয়ারতে আসতে থাকা সাধারণ মুসলমানের ঢল অব্যাহত ছিল। পরের দিন ১৫ এপ্রিল রোববার ফজরের নামাজ শেষে খতম শরীফ, মোরাকাবা, ঈছালে ছাওয়াব, মিলাদ, কিয়াম ও আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় সালানা ওরছে হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু। এ সময় উপস্থিত সকলের কান্না ও আমিন আমিন ধ্বনিতে চারিদিকে এক শোকের পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

মুনাজাতে মোর্শেদে আজম মাদ্দাজিল্লুহুল আলী দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহ্র সমৃদ্ধি এবং দরবারের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু ফুয়ুজাত কামনা করেন।

এমআরএম/পিআর