ফিচার

কেন এই পহেলা বৈশাখ?

১৪ এপ্রিল পালিত হয়ে গেল পহেলা বৈশাখ বা শুভ নববর্ষ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। নতুন বছরের জন্য শুভ কামনা ছিল সবার। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না- কেন এই পহেলা বৈশাখ? বিধি-নিষেধের বেড়াজালে কোনো একসময় নিষিদ্ধ ছিল দিবসটি। সে সব বিষয় নিয়েই লিখেছেন শামীম আরা পিয়া-

Advertisement

বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখ। এ বৈশাখ মাসের প্রথম দিন বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের মধ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের আনুষ্ঠানিক নাম পহেলা বৈশাখ। ইংরেজি মাসের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশে এবং ১৫ এপ্রিল ভারতে দিনটি সার্বজনীনভাবে বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়।

মোঘল আমলে সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষের প্রচলন শুরু করেন। ২০১৬ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন বাংলা নববর্ষকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আনুমানিক ১৯০ বা ২০০ বছর পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্রিটেনের অধীনে ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান ছিল বাঙালি অধ্যূষিত। তবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে নানা রকম দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত হলেও পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা নানাভাবে শোষিত, নিপীড়িত, বৈষম্যের শিকারে পরিণত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের নিজেদের ভাষায় কথা বলারও কোনো অধিকার ছিল না।

অধ্যাপক জয়ন্তকুমার রায় ও অধ্যাপক মুনতাসির মামুন তাদের ‘বাংলাদেশের সিভিল সমাজের আন্দোলন’ গ্রন্থে পাকিস্তান সরকারের দ্বারা বাংলা সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করার বিষয়টি উল্লেখ করেন। এ বই থেকে রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন রকম অনাচার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পাকিস্তান সরকারের এই অনাচারগুলোই পরবর্তীতে বাঙালিদের তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য করে। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন সে সময়কার সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা।

Advertisement

পাকিস্তান সরকারের দ্বারা বাংলা সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করার একটি উদাহরণ হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করা। অর্থাৎ রবীন্দ্র সংগীত বাজানো নিষিদ্ধকরণ করা। এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক এক সভা থেকে মুসলিম লীগ নেতা ও ১৯৭১ সালের দালাল খান এ সবুর উল্লেখ করেন, ‘১ বৈশাখ ও রবীন্দ্র জয়ন্তী বিদেশি (অর্থাৎ হিন্দু) সংস্কৃতির-অনুপ্রবেশ।’ তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন বলেন, ‘রবীন্দ্র সংগীত প্রচার রেডিও থেকে প্রায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পাকিস্তান আদর্শের সাথে না মিললে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

মূলত সম্প্রদায়ভুক্ত চিন্তা-চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সংগীতের প্রচার নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল। নিজেদের সংস্কৃতিকে উপেক্ষার চোখে দেখেছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা মেনে নেয়নি। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তান সরকারের অবজ্ঞার প্রতিবাদস্বরূপ ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে উপর্যুক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ বিশ্বব্যাপী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি বাজিয়ে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়।

এদিন থেকেই বাঙালিরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বাঙালিরা নিজেদের সংস্কৃতির একটি নিদর্শন হিসেবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মতো শুধু মুসলিম চিন্তাভিত্তিক সংস্কৃতির মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ না রেখে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায়। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা।

বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতার এক স্বর্ণসময় প্রত্যক্ষ করা হয় মুক্তিযুদ্ধে। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রের অন্যতম একটি বিষয় ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। সকল ধর্ম, বর্ণ, পেশার মানুষ এক জোট হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং যুদ্ধ করেছে। কোনো রকম ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না, গোষ্ঠী চেতনা ছিল না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় রয়েছে এক অনবদ্য অসাম্প্রদায়িক চেতনার নিদের্শনা। ‘বাংলার হিন্দু মুসলিম সবাই ভাই ভাই; অবাঙালি যারা আছেন তাদের রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের।’ বঙ্গবন্ধুর এ উক্তি থেকেই পাওয়া যায় বাঙালি এক অসাম্প্রদায়িক জাতি। এ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় কোনো একটি জাতিকে বা ধর্মকে অবজ্ঞা করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু হিন্দু, মুসলিমদের পাশাপাশি অবাঙালিদেরও মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।

Advertisement

বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে বিভিন্ন প্রকার উৎসব ও পালা-পার্বণ। বাংলা নববর্ষের উদযাপন তেমনি বাঙালিদের একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব। পহেলা বৈশাখ দিনটি যথাযথভাবে পালনের জন্য সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো দিনব্যাপী বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। পহেলা বৈশাখ সকালে চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় অংশ নেয় সব ধর্ম, বর্ণের মানুষ। এ শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত হয় অসাম্প্রদায়িক বিমূর্ত চিত্ররূপ। সব দুঃখ, কষ্ট মুছে দিয়ে আগামী বছর যেন সবার জন্য মঙ্গলময় হয়- এ কামনা করা হয়।

এই দিনে প্রতিটি বাঙালি পরিবার আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। কারণ বাঙালির চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে বাংলা নববর্ষ। নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আয়োজন করা হয় বিভিন্ন মেয়াদি বৈশাখী মেলার। গণমাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান। বাংলা নববর্ষের সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে এক অসাম্প্রদায়িক বাঙালির পরিচয় তুলে ধরা হয়।

লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/পিআর