ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম বাংলাদেশে। কিন্তু এবারের কোটা বিরোধী আন্দোলন নতুন করে প্রশ্ন নিয়ে এসেছে আমাদের সামনে। ফেসবুক কি– ফেইক নিউজ ফ্যাক্টরি? গুজব সৃষ্টি করে, টার্গেট করে ব্যক্তি বিশেষ বা প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করার ভয়ংকর এক মহড়া দেখা গেল এবার। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে, সভ্যতার সড়কে যে অসভ্যতা প্রদর্শিত হয়েছে, এতে প্রশ্ন আসে এই মাধ্যম এখন আসলে কতটা আশীর্বাদ? কিংবা কতটা অভিশাপ?
Advertisement
শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীরা নয়, বিজ্ঞজনেরাও মিথ্যা রটিয়েছে। উস্কানি দেয়ার জন্য লাইট বন্ধ করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের পেটানো হয়েছে, কিংবা মেয়েদের একটি হলে শিবিরের মত রগ কাটা হয়েছে বলে খবর প্রচার করা হয়েছে। এরকম গুজব এমনসব ব্যক্তি প্রচার করেছে যা ভাবা যায় না। এসব তথ্য সমাজে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত।
মত বা অভিমতের ভিন্নতা এক বিষয়। বিতর্ক হতে পারে। কারো কারো বক্তব্য কারও কারও অবস্থান সঠিক নাও মনে হতে পারে। ভুল তথ্য, বা ভুল খবর সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে, সেটা ছড়িয়ে দিয়ে উস্কানির এমন চেষ্টা দেখে মনে হয়েছে বিজ্ঞানের এই ইতিবাচক উন্মেষ, সামাজিক এই অগ্রগতি যেন আমাদের আসলে হারিয়ে দিচ্ছে। ইতিহাসের প্রত্যেকটা মোড়ে, প্রতিটা বাঁকে পৌঁছে সভ্যতা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এরপর সে এগিয়েছেও। নিশ্চয়ই এই অবস্থা থেকেও এগুবে বাংলাদেশ। কিন্তু কতটা মূল্য দিতে হয় কে জানে।
সভ্যতার পথে সামাজিক মাধ্যমের বড় আবির্ভাব, এক বড় মাইলফলক। এই মাইলফলককে বিজ্ঞানের সাথে সমাজের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। অনন্ত সম্ভাবনার দিগন্ত খুলছে এই মাধ্যম। কিন্তু এই অংশীদারিত্ব শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক পথে চলবেতো?
Advertisement
সামাজিক মাধ্যমের বিস্তারের ফলে জনসাধারণ খুব সহজে ও অল্প সময়ে বিভিন্ন তথ্য পাচ্ছে। কিন্তু সব তথ্য তথ্য নয়। বিপুল পরিমাণ অনলাইন পোর্টাল এমনসব মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে সেইসব নিউজ আবার সামাজিক মাধ্যমে করছে।
সম্প্রতি কোন এক ম্যাজিষ্ট্রেট তার মাকে স্টেশন ফেলে গেছে বলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সত্যাসত্য যাচাই না করে কত মানুষ যে এই নিউজ শেয়ার করেছে তার পরিসংখ্যান দেয়া কঠিন। এমন কি দু’একটি মূল ধারার মাধ্যমও এর ভিত্তিতে খবর প্রচার করেছে।
কিংবা খবর কেউ প্রচার করে দিল কোন এক বিখ্যাত কেউ আর নেই বা কারও সম্পর্কে বড় কোন নেতিবাচক সংবাদ। দাবানলের চেয়েও দ্রুত ছড়ায় এসব সংবাদ। কতজন যে এই প্রবণতার শিকার বলা মুশকিল। এসব এত দ্রুত ছড়ায় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কিছু টের পাওয়ার আগেই অনেক কিছু ঘটে যায়। বিপদ এখানেই।
সাম্প্রদায়িক গুজব, উগ্র মৌলবাদী মিথ্যাচার, সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক জল্পনা, গণ-আতঙ্ক সৃষ্টির মতো তথ্য- এ সবই হচ্ছে আজ। ভুয়া সংবাদ, অনেক ক্ষতিকর বিষয়বস্তু সামাজিক মাধ্যম বেয়ে মাঝেমধ্যেই দাবানলের মতো ছড়ায়, যাতে বহু মানুষের জীবন যায়।
Advertisement
আজকাল এসব অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে বাড়ছে। রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িযায়, রংপুরে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা হলো এই মাধ্যম বেয়েই। এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা বিপর্যয় নামাচ্ছে বারবার। এই কোটা আন্দোলনেও তা হয়েছে। মিথ্যা তথ্য প্রচার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত হয়েছে।
একটি ক্ষমতাবান গোষ্ঠী এক ধরনের আদর্শ স্থাপনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায়। এই পদ্ধতি অন্য সময়ে বিভিন্ন স্থানে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে এই আদর্শ স্থাপনের সুফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। এই গোষ্ঠী তরুণদের সন্ত্রাসবাদী ধারণায় বিকশিত করছে, রাষ্ট্রের সংহতি নষ্টের ঊর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে।
ছাঁকনিটা তাই খুব দরকার এই মুহূর্তে। সামাজিক মাধ্যমে সেই ছাঁকনি এখনও নেই, যা ভুয়া খবরকে চিনে নিতে পারে। আপাতত তাই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদেরই সতর্ক হতে হবে। কোনটায় বিশ্বাস করব, আর কোনটাকে করবনা তা চিনে নেওয়ার মতো চোখ তৈরি করতে হবে। প্রত্যেককেই অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
সামাজিক মাধ্যম এসেছে মানুষের জন্য। মানুষই চালিয়ে নিচ্ছে। শিক্ষিতজনের মাধ্যমকে ঘিরে প্রশ্নচিহ্নের উল্লাস। মানুষ এবং শিক্ষিত মানুষই গুজব ছড়ায়, গুজবকে রাজনৈতিক ও হীন সাম্প্রদায়িক কারণে ব্যবহার করে। সামাজিক মাধ্যম মগজ ধোলাইয়ের পাটাতন হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সংকটকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায় কখনো কখনো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করার জন্যও সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষাটা খুবই প্রয়োজন। কিভাবে এই মাধ্যমকে কেউ ব্যবহার করবে, সেটাও তাকে শিখতে হবে। সামাজিক মাধ্যম এসবকে উত্তীর্ণ করতে পারবে কিনা – সেটাই বড় প্রশ্ন। ইতিবাচক আবিষ্কার শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদ আখ্যা পাবে, নাকি অভিশাপে পর্যবসিত হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে আমাদেরই।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/আরআইপি