জাতীয়

সোনার মানুষ হওয়ার কামনায় মঙ্গল শোভাযাত্রা

সোনার মানুষ হওয়ার কামনায় হল ১৪২৫ সনের বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’

Advertisement

শনিবার সকাল ৯ টায় শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে শুরু হয়। এরপর শোভাযাত্রাটি হোটেলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল (আগের রূপসী বাংলা), শাহবাগ ও টিএসটি মোড় ঘুরে ফের চারুকলার সামনে গিয়ে সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে শেষ হয়।

শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে।

শোভাযাত্রায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো ছিল পুরো এলাকা।

Advertisement

 

শোভাযাত্রা নিয়ে আশঙ্কা ও নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানে সবকিছুই। ঢাক-ঢোলের বাদ্যি আর তালে তালে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য, হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ-উল্লাস মাতিয়ে রেখেছিল পুরো শোভাযাত্রা।

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে হওয়া এ শোভাযাত্রা।

সকাল থেকেই টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় মানুষ জড়ো হতে থাকে। নয়টার মধ্যেই পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। লাল-সাদা পোশাকে উচ্ছল নারীদের মাথায় শোভিত নানান রঙ্গের ফুলের টায়রা। তরুণদের পরনে ছিল লাল-সাদা পাঞ্জাবি।

 

শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। পুলিশ, র্যাবের সঙ্গে ছিল সোয়াত সদস্যরা। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তৎপর ছিলেন। আকাশে ছিল র্যাবের হেলিকপ্টারের টহল।

Advertisement

শোভাযাত্রার ছিল বিশাল আকৃতির মহিষ। মহিষের উপর বসে আছে কয়েকটি রঙ্গিন পাখি। শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা উড়িয়ে দেয়া ভঙ্গিকে একজন নারীর প্রতিকৃতি ছিল শোভাযাত্রায়। বিশালাকায় কাঠামোয় তৈরি করা লাল-সাদা বক, বকের ঠোঁটের সামনে রাখা হয় সমান আকৃতির একটি মাছ।

হলুদ-লাল হাতি ও জেলের প্রতিকৃতিও ছিল শোভাযাত্রায়। এছাড়া পোঁচা, টেপা পুতুল, সূর্য, রাজা-রানীসহ নানা আকৃতি ও রংয়ের মুখোশ ছিল শোভাযাত্রায়। এছাড়া ছিল রঙিন মা পাখি ও ছানার প্রতীকী কাঠামো। চারপাশে ফুলের মাঝে বড় একটি মুখের প্রতিকৃতিও ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রায়।

শোভাযাত্রায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য পালকিরও দেখা মিলেছে। তরুণরা সেজেছিলেন কৃষক।

সব শ্রেণির মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে উৎসব মুখর ছিল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির দফতর সম্পাদক রায়হানুল ইসলাম আবির বলেন, ‘বছরের শুরুটা নিজেকে শুদ্ধির মধ্য দিয়েই হওয়া উচিত। নববর্ষের যে আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং পান্তা ইলিশ খাওয়া এসবকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা ভাবলে চলবে না। এর মধ্যে নিজেকে শুদ্ধির মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতিকে লালনের বার্তা রয়েছে। আমাদের উচিত এখন থেকেই নিজেকে পরিবর্তন করা।’

রোকেয়া হলের ছাত্রী আফসানা নিগার বলেন, ‘আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই মানুষ সোনার মানুষ হতে পারে। আমরা যত আত্মসমালোচনা করবো ততই নিজেকে শুদ্ধ করতে পারবো। যার মধ্য দিয়ে সমাজের কাঙ্ক্ষিত মানুষ হতে পারবো।’

রাজধানীর পান্থপথ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় আসা সায়মা ইসলাম বলেন, ‘নববর্ষের শুরু থেকেই আমরা নিজেদের সঠিক পথে পরিচালনার শপথ নেবো। যাতে করে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অংশীদার হতে পারি।’

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এই উৎসবের ভেতর দিয়ে যে বাংলাদেশ গড়ে উঠছে এবং ইউনেস্কোর যে স্বীকৃতি আমরা পেয়েছি তা আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আজকে নতুন বছরে আমাদের প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা হোক আমরা সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য এগিয়ে যাব। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকলের সকলের ঐক্য, সম্প্রীতি, সকলের ভালবাসা ও সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘শোভাযাত্রায় এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় লালন সাঁইয়ের অমর বাণী- মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। জাতির জনক স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনার বাংলা বিনির্মাণের। তিনি সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য সোনার মানুষ প্রত্যাশা করতেন। লালন সাঁইয়ের এই বাণীর মধ্যে সোনার মানুষ হওয়ার বক্তব্য আছে। সোনার মানুষ হতে হলে মানুষকে ভালবাসতে হবে, মানবতাবাদী হতে হবে।’

বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। তখন এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সালে এর নাম হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।

বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও কয়েক বছরের পুরনো। ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে।

যশোরের সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পরে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।

আরএমএম/এমএইচ/এসএইচএস/আরআইপি