অতি সম্প্রতি আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করেছি একটি আনন্দ সংবাদ। আর তা হলো, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পাবে। আনন্দ সংবাদ তো বটেই, কারণ বহু বছর ধরেই আমরা বলে আসছিলাম, পরীক্ষার খাতায় লিখছিলাম, ‘বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ’। এবার তা সত্যি হচ্ছে।
Advertisement
উন্নয়নও হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ। শহরে এবং গ্রামের নিন্ম আয়ের মানুষের হাতেও এখন দেখা যায় স্মার্টফোন। সপ্তাহের পাঁচদিন আমি বিকেলে বাড়ি ফিরি একটি শপিং মলের সামনে দিয়ে। মলটি আমার বাড়ির খুব কাছেই।
সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার, আমি ওখানে বাজার করি। এক ছাদের নিচে সব পাওয়া যাবার সুবিধা অনেক। সময় বাঁচে। তবে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটাও হয়ে যায়, চোখের তৃষ্ণায়। বড় শপিং মলের বৈশিষ্ট্যই এমন।
শপিং মলের বাইরে সবসময় তরুণ ছেলে-মেয়েরা গাদাগাদি করে বসে থাকে। পাশেই দাঁড়ানো থাকে কিছু বাদাম, চানাচুর, চাওয়ালা। কফিশপও আছে। আছে ফুডকার। যখনই তাকাই দেখি সবাই মাথা নিচু করে আছে। ঢোকার সময় এবং বেরুনোর সময় একই দৃশ্য। সেদিন ভাবলাম দেখি তো এতো এতো ছেলেমেয়ে এখানে মাথা নিচু করে বসে থাকে কেন? প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বাদাম খেলাম। দেখলাম, সবারই হাতে স্মার্ট ফোন। সবাই ব্যস্ত স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে, কারো সঙ্গে বাস্তবে কথা বলার সময় তাদের নেই।
Advertisement
মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, একটু পরপর নোটিফিকেশন চেক করা, কাজ ফেলে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা, এই অভ্যেসগুলো কারো মধ্যে দেখা গেলে বুঝতে হবে সে স্মার্টফোন আসক্তিতে আক্রান্ত। অর্থাৎ সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আসক্ত। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে মাদক না পেলে অস্থির হয়ে যায়, তার মস্তিষ্কে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল নির্গত হতে শুরু করে।
গবেষকরা আরও দেখিয়েছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আসক্ত একজন মানুষও নির্দিষ্ট সময়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, ভার্চুয়াল জগতে যুক্ত হতে না পারলে সেও অস্থিরতায় ভোগে। তার মস্তিষ্কেও বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল নির্গত হতে শুরু করে। আরও সহজ করে বলা যায়, সত্যিকারের মাদকাসক্তির সঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের আসক্তির কোন পার্থক্য নেই।
অ্যালকোহল আসক্তির চেয়েও মারাত্মক হলো ভার্চুয়াল আসক্তি। এই রোগিরা সহজে বাস্তবে ফিরতে পারে না। এই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক একজন মানুষকে আনসোশ্যাল এবং একা করার জন্য যথেষ্ট।
২০১৮ সালে প্রণীত ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অফ ডিজিজ এ প্রথমবারের মতো ভিডিও এবং অনলাইন গেম আসক্তিকে একটি ‘মানসিক রোগ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
Advertisement
আমেরিকার কলেজ অব পেডিয়াট্রিশিয়ানস এর মতে, শিশুদের অনিন্দ্রা, মেদ, স্থূলতা, আগ্রাসী মনোভাব, আত্মবিশ্বাসহীনতা এর অন্যতম কারণ স্ক্রিনে আসক্তি। (সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান)।
যখন তখন যত্রতত্র সেলফি তোলার প্রবণতাকে এখন আর নিছক হাস্যকর নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেম বলে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। কারণ সেলফিজনিত কারণে পৃথিবীর সর্বোচ্চ মৃত্যু হারের দেশ ভারতে চারশ জনের উপর গবেষণার ভিত্তিতে মনোবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, যারা ঘন ঘন সেলফি তোলেন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেলফি পোস্ট করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন, তারা ‘সেলফিটিস’ নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত।
আগে গোয়েন্দা বিভাগকে কারো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে বেশ সময় এবং শ্রম দিতে হতো। কিন্তু এখন? ভার্চুয়াল আসক্তরা নিজেই যাবতীয় তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে রাখছে।
ভার্চুয়াল আসক্তদের পৃথিবী ছোট হতে হতে হাতের তালুতে চলে এসেছে। অথচ বাস্তব হলো, পৃথিবী বিশাল। মানুষ সাধারণ নিজের সন্তানদের ভাল কিছু দেয়ার চেষ্টা করে। কষ্ট করে হলেও ভালটা সন্তানকে দেয়। অথচ স্টিভ জবস এবং বিলগেটস তাদের সন্তানদের বয়স ১৪ হবার আগে মোবাইল ফোন দেননি।
আমাদের চিত্র উল্টো। শিশুদের হাতেই সবচেয়ে বেশি থাকে স্মার্টফোন। কার্টুন আর গেম ছাড়া তারা খেতে চায় না। আসলে তথ্য প্রযুক্তি বিষয় ভাল করে জানার আগেই আমাদের হাতে চলে এসেছে এইসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং ভার্চুয়াল জগত।
বুঝে না বুঝে আমরা প্রযুক্তির অপরিণামদর্শী ব্যবহার করছি দিনের পর দিন। তাতে সমাজে বেড়েছে প্রতারণা, অবিশ্বাস এবং প্রতিহিংসা। স্বাধীনতা বেড়েছে কিন্তু সচেতনতা বাড়েনি। আমি নিজেও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি। কিন্তু সেটা আমার প্রয়োজন অনুযায়ী। সারাক্ষণ না।
বুঝতে হবে খাবার না খেয়ে, শুধু খাবারের ছবি দেখে তো আমাদের পেট ভরবে না। যদি ভরতো তাহলে সারাক্ষণ ভার্চুয়াল জগতে পড়ে থাকলেও কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু নিজের কাজ, নিজেকেই করতে হবে। তাই পুঁজিবাদীদের হাতের পুতুল না হয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে নিজেকেই।
নিকট অতীতে আমরা মাদককে না বলেছি। এসিড সন্ত্রাসকে না বলেছি। এখন নিশ্চয়ই আমরা ভার্চুয়াল আসক্তিকে না বলতে পারবো। আমাদেরকে পারতেই হবে। লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/আরআইপি