কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার পৌরসভার ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড়ে আড়াইবাড়িয়ায়। প্রতিবছর বৈশাখ এলেই এ এলাকার জনপদের মানুষের জীবনের রং বদলায় যায়। গ্রামটি এরই মধ্যে স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি পেয়েছে, কাস্তে পল্লী হিসেবে। উত্তর ও মধ্য আড়াই বাড়িয়া গ্রামের ৫ শতাধিক পরিবারের দুই হাজারেরও বেশি মানুষ কাস্তে তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে বংশ পরস্পরায় এ পেশায় জড়িত। সারা বছরই এখানে কাস্তে তৈরি হয়। তবে ধান কাটার মৌসুমের জন্য অপেক্ষায় থাকে সবাই। এ সময়টায় বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই। যে যত বেশি কাজ করবে, ততো উপার্জন। তাই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কাস্তে তৈরির কাজ।
Advertisement
জানা যায়, হাওরে পাকা ধান কাটতে লোহার তৈরি ধারালো কাস্তের কোন বিকল্প নেই। তাই কাস্তের তৈরির এমন ছন্দময় দৃশ্য আর কর্মমুখরতা জেলার হোসেনপুর উপজেলার আড়াইবাড়িয়া গ্রামে। এখন চলছে বোরো ধান কাটা মৌসুম। তাই মুখর কাস্তে পল্লী। গ্রামের মানুষ এখন ব্যস্ত ধান কাটার কাস্তে তৈরিতে। সবাই মেতেছে কর্মউৎসবে। এবার প্রায় ৫০ লাখ কাস্তে তৈরি হচ্ছে এখানে।
কিশোরগঞ্জ ছাড়াও হোসেনপুরের কাস্তে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল ছাড়াও যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার প্রতি হাজার কাস্তে পাইকারি দামে বিক্রি হচ্ছে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। তবে লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ কমেছে। কামাররা আগুনের পাশে বসে লোহা পিটিয়ে শরীরের ঘাম ঝরালেও, মূলধনের অভাবে লাভের একটা বড় অংশ চলে যায় দাদন ব্যবসায়িদের হাতে। এ শিল্পের বিকাশে মিলছেনা সহজ শর্তে ঋণ।
হোসেনপুরের কাস্তে পল্লীখ্যাত উত্তর ও মধ্য আড়াইবাড়িয়া গ্রামে সরজমিনে দেখা যায়, গ্রামের সবার মাঝে কর্মমুখরতা চোখে পড়ের মতো। গ্রাম জুড়ে উৎসবের আমেজ। আড়াইবাড়িয়া গ্রামে তিন হাজার মানুষের বাস। এর মধ্যে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ কাস্তে তৈরি করে জীবন চালায়। গ্রামের, ছোট-বড় শতাধিক কামারশালায় কাজ করে নানা বয়সের প্রায় দেড় হাজার মানুষ। চৈত্র মাসের শুরু থেকেই কাস্তে তৈরির ধুম পড়ে। অনেকেই আগুনের আগুনের ফুলকির পাশে বসে শরীরের ঘাম ঝড়িয়ে লোহার পাতে হাতুড়ি পিটিয়ে কাস্তে তৈরি করছে। কাস্তে তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে লোহা আর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশীয় কয়লা।
Advertisement
একই গ্রামের মো. আতাহার আলী ২৫ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। তার কামারশালায় কাজ করছেন ১৬ জন শ্রমিক। তিনি জানান, এবার তিনি আড়াই লাখ কাস্তে তৈরি করেছেন। এরই মধ্যে বেশির ভাগই বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতিটি কাস্তে তৈরিতে খরচ পড়েছে ১৪ টাকা। বিক্রি হয়েছে ১৫ টাকা করে।
কামারশালার মালিক মো. আজহারুল ইসলাম জানান, লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার কাস্তে তৈরির খরচ বেশি পড়ছে।
কাস্তে শ্রমিকরা জানান, পরিশ্রম বেশি হলেও এ শিল্পকে ঘিরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা জানান, প্রতি ১০০ কাস্তের মূল কাঠামো তৈরি করে ৩০০ টাকা, রেত দেয়ায় ২৫০ টাকা, দাঁত কাটায় ১৬০ টাকা, লোহা কাটায় ৫০ টাকা এবং কয়লার জন্য ৮০ টাকা করে মজুরি দেয়া হয়। একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারে।
তবে এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায় মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। ফলে নিজেরা লাভবান হচ্ছেন কম।
Advertisement
হোসেনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, এ শিল্পকে চাঙ্গা রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কামারদের মধ্যে সমাজসেবার মাধ্যমে ঋণ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
নূর মোহাম্মদ/আরএ/পিআর