সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ নিজের মতো করে গল্প করে, গল্প বলে। গল্প করা আর গল্প বলা সমর্থক হলেও গল্প লেখা ভিন্ন ও তুলনামূলকভাবে কষ্টসাধ্য কাজ। মানুষের জীবনে প্রতিটি সেকেন্ড একেকটা ছোটগল্প। জীবনগল্পের সেই অসংখ্য অংশের মধ্যে পাঠকের কাছে কোন অংশটুকু উপস্থাপন করবেনÑসে বোধ-বিবেচনার মধ্য দিয়ে গল্পকারের পারদর্শিতা প্রকাশ পায়। প্রবাহমান জীবনের বিশেষ অংশটুকু পাঠকের সামনে তুলে ধরা গল্পকারের সবচেয়ে বড় গুণ। বিষয় নির্বাচনে কৌশলী গল্পকার মঈনুল হাসান এ ক্ষেত্রে স্বার্থক বলা চলে। ‘সন্ধ্যা নামার আগে’ গ্রন্থটি পড়ামাত্রই লেখককে গল্পবলায় পারদর্শিতার জন্য শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাতে কুণ্ঠিতবোধ করবেন না।
Advertisement
বইটির ‘মায়া মন্থন’ গল্পটিতে লেখক মানুষের ভেতরের আচরণ খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের খণ্ডিত অংশ হচ্ছে : ‘মাছের গদিঘর থেকে ওসমানের গমনপথের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে উপেন। ওসমান মিলিয়ে গেলে হালকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বুকে চেপে বসা পাথরটাকে সরিয়ে দেয় সে। হয়তো বুকের অদৃশ্য কোণে লুকিয়ে থাকা উথলে ওঠা মায়াটাকে আড়াল করতে চায়। ওসমানের প্রতি কপট রাগের এ বহিঃপ্রকাশ যে সত্য নয় এবং তা যে কেবল অভিনয় মাত্র তা রহমতের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় করে বুঝিয়ে দিতে চায় উপেন।’ এভাবেই বইটির প্রতিটি গল্পে জীবনবোধ চমৎকার শব্দশৈলীতে উপস্থাপন করেছেন লেখক। মানুষের ভেতরের আচরণকে গল্পবলার ছলে উপস্থাপন করার কৌশল বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ব করেছেন গল্পকারÑএ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
কষ্ট ক্লেদ এমনকি সন্দেহ কিভাবে ভুলে যায় মানুষ ‘জনক’ গল্পটি তার চমৎকার উদাহরণ। বিষিয়ে ওঠা জীবনের কোনো কোনো সময় মানুষ সব গ্লানি জীবন থেকে মুছে ফেলে। জীবনের প্রয়োজনে আমাদের সমাজের নারীরা কত কঠিন সত্যকে গোপন করে তা ফুটে উঠেছে ‘জনক’ গল্পের রেশমা চরিত্রে। গল্পে রেশমা চরিত্রটি রূঢ় বাস্তবতায় ঘেরা। যদিও গল্পটিতে সন্দেহ আর বিষণ্নতাকে ছাপিয়ে সফল সমাপ্তি টেনেছেন লেখক। গল্পের প্রথম থেকেই নূরা তার স্ত্রী রেশমাকে সন্দেহ করে। উৎকণ্ঠা শেষে গল্পটির সমাপ্তি হয় এভাবে, ‘ঝুপড়ি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল এক করে চিৎকার দিয়ে উঠে নূরা। তারপর এক ঝটকায় ঝাঁপ ঠেলে ভেতরে ঢুকে রেশমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে। কীরে বউ? এই খুশির খবর আমারে আগে দিলি না যে? কাইল রাতেই কইতে চাইছিলাম। ঘটনা কি আসলেই সত্য? লজ্জাজড়ানো কণ্ঠে রশমা শুধু বলে, হ। তুমি বাবা হইবা।’
গ্রন্থটিতে প্রকৃতির উপস্থাপনেও রয়েছে ভিন্নতা। জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে প্রতিটি গল্পে। আছে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিবিধ উপকরণের যথার্থ প্রয়োগ। যা আমাদের ঐতিহ্যকে চোখের সামনে তুলে ধরে। যেমন ‘সন্ধ্যা নামার আগে’ গল্পে লেখক বলেছেন, ‘বস্তির জীবন অমনই যার সংজ্ঞা কোথাও লেখা থাকে না। সিনেমার মতো সেখানে কোনো বিরতি নেই, শুধুই বিরামহীন ছুটে চলা।’
Advertisement
‘সন্ধ্যা নামার আগে’ বইটি মঈনুল হাসানের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। ২০১৮ একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে মূর্ধণ্য প্রকাশনী। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। শুভেচ্ছা মূল্য রাখা হয়েছে দুইশ পঞ্চাশ টাকা।
এইচআর/পিআর