অনিয়ম, দুর্নীতি আর নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা লুট, ঋণের টাকা ভাগাভাগিসহ ব্যাংকগুলোর মূলধন শূন্য করে ফেলারও অভিযোগ রয়েছে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘সব খেয়ে এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের দিকে নজর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর।’
Advertisement
তারা এমনও বলছেন, বেসরকারি ব্যাংকমালিকদের কোণঠাসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারও দিচ্ছে সায়। চাপের মুখে বাধ্যতামূলক নগদ জমা (সিআরআর) এবং রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বেসরকারি ব্যাংকমালিকদের চাপে সরকারি তহবিলের ৫০ ভাগ অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। আগে এ হার ছিল ২৫ ভাগ। অর্থাৎ সরকারি তহবিলের অর্থ ৭৫ ভাগ থাকত সরকারি ব্যাংকে এবং বাকি ২৫ ভাগ রাখা যেত বেসরকারি ব্যাংকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে গত ২ এপ্রিল এ সঙ্ক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে যেন হরিলুট চলছে। অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে বাড়ছে খেলাপি। কিন্তু জড়িতদের শাস্তি হয় না। তারল্য সঙ্কটের মূল কারণ আগ্রাসী ঋণ বিতরণ। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংককে দেয়া হচ্ছে। এভাবে জনগণের অর্থ দেয়া মানে সহজে অর্থ লুটের সুযোগ করে দেয়া। তাই অর্থ দেয়ার আগে কঠোর শর্তারোপ করতে হবে- এমনটি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
Advertisement
তাদের মতে, ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়ম নিয়ে মানুষের মনে উৎকণ্ঠা রয়েছে। এর মধ্যে হঠাৎ সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে দেয়ার সিদ্ধান্ত মানে ব্যাংকের সঙ্কট আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংক সরকারের, টাকাও সরকারের। সুতরাং আমানতের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকগুলো অগ্রাধিকার পাবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকে সরকারের আমানত ৫০ শতাংশ দেয়া কিছুতেই ঠিক হবে না। এই টাকা যদি ভালো ব্যাংক ছাড়া সমস্যায় থাকা ব্যাংকে যায়, তাহলে দেখা যাবে সরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। সুতরাং এটার কোন প্রয়োজন ছিল না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ব্যাংকের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের এখন পর্যন্ত কারও দৃশ্যমান শাস্তি হয়নি। তাই সরকারি টাকা রাখার আগে যাচাই-বাছাই করতে হবে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণসহ সার্বিক মান যাচাই করতে হবে। এর বাইরে যে প্রতিষ্ঠান টাকা রাখবে তার দায়-দায়িত্ব নিজেদেরকেই নিতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফারমার্স ব্যাংকে জলবায়ু তহবিলের ৫০৯ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। এখন সে টাকা পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকটি। এতে তহবিলটির ব্যয় আটকে গেছে। এভাবে জনগণের অর্থ দেয়া ঠিক নয়। তাদের ৫০ শতাংশ আমানত দেয়া যুক্তিসংগত নয়।’
Advertisement
সাবেক এ ব্যাংকার বলেন, ‘অর্থ দেয়ার আগে শর্ত দিতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি ভালো ব্যাংক হতে হবে এবং সরকারের যে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অর্থ রাখবে দায়-দায়িত্ব তার নিতে হবে।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘ব্যাংকমালিকদের চাপের মুখে বাধ্যতামূলক নগদ জমা (সিআরআর), রেপো সুদহার কমানো এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থার তহবিলের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাখার সিদ্ধান্তে পুরো ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংককে সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে যে, তার ভূমিকাটা কী? এ দুটি সিদ্ধান্তই সঠিক উপায়ে নেয়া হয়নি।’
৫০ শতাংশ আমানত বেসরকারি ব্যাংকে রাখার প্রসঙ্গে সেলিম রায়হান বলেন, ‘যেসব ব্যাংক এখন খারাপ করছে, তাদের আবার টাকা দেয়া হলে সেই টাকার অপব্যবহার হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই লাখ কোটি টাকা সরকারি আমানত। বাকি আট লাখ কোটি টাকা বেসরকারি আমানত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি আমানতের ৭৫ শতাংশ তথা দেড় লাখ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় জমা থাকার কথা। বাকি ৫০ হাজার কোটি টাকা জমা থাকার কথা দেশের ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকে।
তবে ঠিক কী পরিমাণ সরকারি আমানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় জমা আছে, সে সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এখন নতুন নীতিমালা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেই হিসেবে এক লাখ কোটি টাকা রাখতে হবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে।
এসআই/এমএআর/জেআইএম