কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার অবশ্যই চাই। তবে যারা আমার লেখা টুকটাক পড়েন তারা জানেন, আমি কোটা ব্যবস্থার সমর্থক। আমি বিশ্বাস করি বৈষম্য সৃষ্টি করতে নয়, বৈষম্য দূর করতেই কোটা ব্যবস্থার প্রচলন। সমাজের অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে মূলধারার সুবিধায় আনতেই কোটা ব্যবস্থা থাকা দরকার। কোটা না থাকলে আদিবাসী, নারী, প্রতিবন্ধীরা পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে না। মুক্তিযোদ্ধা কোটারও আমি প্রবল সমর্থক। যারা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আমাদের জন্য একটা স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছেন, তাদের প্রতি অবশ্যই আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। তারা চান বা না চান, রাষ্ট্রের উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের প্রতিদান দেয়া, তাদের সন্তানদের জন্য বাড়তি সুবিধা নিশ্চিত করা।
Advertisement
যতই মেধাবী হোক, স্বাধীনতা বিরোধী চেতনা ধারণ করে, এমন কারো রাষ্ট্রের সুবিধা পাওয়া উচিত নয়। কিন্তু ২০১৩ সালের এবং এবারের কোটা সংস্কারের আন্দোলন দেখে আমার মনে হয়েছে, এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধ। আন্দোলনের নামে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করে স্লোগান দেয়া হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে বোঝানো হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারাই তোমাদের চাকরির পথে মূল প্রতিবন্ধক। কোটা সংস্কার প্রশ্নে আন্দোলন নিয়ে আমার মূল আপত্তিটা এখানেই।
২০১৩ সালের আন্দোলনের সময় মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ফেসবুকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘তরুণ প্রজন্মকে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া না হয়।’ তার ক্ষোভ, তার অভিমানটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। কদিন আগে এক লেখায় আমিও বলেছিলাম, প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা হোক। তবু যেন তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করানো না হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে না পারি, তাদের অপমান করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। মুক্তিযুদ্ধে নেতত্বদানকারী দল যখন ক্ষমতায়, তখন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজপথে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী স্লোগান শোনা অবমাননাকর।
কোটা ব্যবস্থার কট্টর সমর্থক হলেও আমি বরাবরই কোটা সংস্কারের পক্ষে। আমার দৃষ্টিতে কোটার সবচেয়ে বড় অব্যবস্থাপনা ছিল, কোটায় লোক পাওয়া না গেলেও পদ শূন্য রাখা। কিন্তু সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোটায় লোক পাওয়া না গেলে সাধারণ প্রার্থীদের মধ্য থেকে নেয়া হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তরুণ প্রজন্মের বঞ্চনার বোধ কমে আসবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কখনো কখনো কোটা কমে আসবে ২০ শতাংশে।
Advertisement
আমি ভেবেছিলাম এই সিদ্ধান্তের পর আপাতত আন্দোলন করার দরকার নেই। অন্য দাবিগুলোও পর্যায়ক্রমে বিবেচনার সুযোগ আছে। এই আন্দোলন নিয়ে আরেকটি আপত্তি আছে আমার। বাংলাদেশে নির্বাচন সামনে এলেই যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা দাবিতে মাঠে নামে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের ধারণা নির্বাচন সামনে রেখে সরকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে। কদিন আগে শিক্ষকরা দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছিলেন। নির্বাচনের আগের মৌসুমী আন্দোলনকে আমার কাছে আন্দোলন মনে হয় না, মনে হয় ব্ল্যাকমেইল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকেও আমার তেমনই মনে হচ্ছে।
২০১৩ সালেও নির্বাচনকে সামনে রেখে কোটা সংস্কারের আন্দোলন হয়েছে। এবারও নির্বাচনকে সামনে রেখেই মাঠে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। মাঝখানের ৫ বছর কিন্তু কোনো আন্দোলন ছিল না। দাবি যৌক্তিক হলে আপনি যে কোনো সময় আন্দোলন করতে পারেন।
আগেই বলেছি, কোটায় লোক পাওয়া না গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নেয়া হবে, এই সিদ্ধান্তের পর চলমান আন্দোলনকে আমার কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমার কাছে যৌক্তিক মনে না হওয়াটাই তো শেষ কথা নয়। ভিন্নমত পোষণের অধিকার আমার যেমন আছে, সবারই আছে। যারা আন্দোলন করছেন নিশ্চয়ই তাদের কাছে তাদের দাবির যৌক্তিকতা এখনও রয়েছে। আন্দোলনটি আমি সমর্থন করতে না পারি, কিন্তু আন্দোলনকারীদের আন্দোলন করার অধিকারের প্রতিও আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তাৎক্ষণিক বঞ্চনার কারণে তারা হয়তো কোটার প্রয়োজনীয়তাটা বুঝতে পারছে না, মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করছে, তাদের নিয়ে ট্রল করছে। তারপরও তাদের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা রয়েছে।
উচ্চশিক্ষা শেষে সবারই যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারের কথা রাজপথে নেমে জোর গলায় বলারও অধিকার তাদের রয়েছে। আমি জানি বাংলাদেশে মানুষ বেশি। তাই সবাই কখনোই যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবে না। কোনো কোটা না থাকলেও তো কেউ না কেউ বঞ্চিত থেকেই যাবে। আর কোটায় যারা চাকরি পাচ্ছে, তারাও তো বাংলাদেশেরই সন্তান। অনেকে বলছেন, কোটায় মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এই যুক্তিতেও আমার প্রবল আপত্তি। কোটা সুবিধা পেতে হলেও একজনকে প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত যারা পৌঁছান, তারা সবাই কাছাকাছি মানের মেধাবী। তাই কোটা প্রয়োগ হলেই দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাবে, এমন ধারণাও ঠিক নয়।
Advertisement
কারো কাছে যৌক্তিক মনে হবে, কারো কাছে অযৌক্তিক। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে, যে কোনো দাবি নিয়ে রাজপথে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার অধিকার সবারই আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা আইন হাতে তুলে না নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেখানে কিছু করার নেই।
আন্দোলনকারীদের অবস্থানের কারণে শাহবাগে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এটা ঠিক। বাংলাদেশে আগেও অনেক কারণে রাস্তা বন্ধ থাকে। কিছুদিন পরপরই আওয়ামী লীগের সমাবেশের কারণে অচল হয়ে যায় গোটা ঢাকা। তাই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কিছুক্ষণ সড়ক অবরোধ করে রাখলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। পুলিশ ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে পারতো। না হয় তারা একরাত শাহবাগ বন্ধ করে রাখতোই। পুলিশ বরং তাদের পাহারা দিয়ে রাখতে পারতো। কিন্তু পুলিশ যেভাবে নিষ্ঠুর কায়দায় শিক্ষার্থীদের হটিয়ে দিয়েছে তা অন্যায়, অমানবিক।
আমরা জানি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মানুষের অভাব নেইা। পুলিশ সেই পানি ঘোলা করার কাজটুকু করে দিয়েছে। তাই এখন মাছ শিকার নেমে পড়েছেন অনেকেই। বরাবরই আমার বিশ্বাস, চাকরি বঞ্চিত তরুণদের আবেগকে উস্কে দিয়ে একটি মহল পেছন থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার বিষ ছড়িয়ে দিতে চাইছে। ৭৫এর পর ২১ বছরে বাংলাদেশে যতটা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা করা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে তার চেয়ে কম হয়নি। তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলাটা অনেক বড় ক্ষতির। তারপরও কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সবাইকে আমি ঢালাওভাবে বিএনপি-জামায়াতের বলে মনে করি না। এমনকি ছাত্রলীগের অনেক বঞ্চিত শিক্ষার্থীও এ আন্দোলনে আছে। কিন্তু পুলিশী হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যা হয়েছে, তা ন্যক্কারজনক।
আন্দোলনের সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অনেকে সুযোগ নিতে চাইছে। অনেকে মুখে কাপড় বেঁধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। চারুকলায় বর্ষবরণের শোভাযাত্রার প্রস্ততিতে হামলা চালিয়েছে। ২০১৩ সালের আন্দোলনের সময়ও চারুকলায় বর্ষবরণের শোভাযাত্রার মোটিফ ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে যা হয়েছে তা নজিরবিহীন, লজ্জাজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই আন্দেলনের লক্ষ্য নন। এই আন্দোলনের দাবি পূরণের ব্যাপারে তার কিছুই করার নেই। কিন্তু গভীর রাতে যেভাবে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসেংযোগ বরা হয়েছে; তার কোনো উদাহরণ নেই।
উপাচার্যের বাসভবন দেখার পর কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এই আন্দোলনের কলকাঠি আসলে অন্য কেউ নাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রের পক্ষে তাদের উপাচার্যের বাসভবনে এভাবে হামলা চালানো সম্ভব নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা গেলে, সেখানে একটি লাশ ফেলা গেলে কারো কারো সুবিধা হয়। রাতে একজনের মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয়েছে। যদিও পরে সেই ছাত্র এবি সিদ্দিক সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন।
আগেই বলেছি, দাবি যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক; যে কারো শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার অধিকার আছে। যারা এই আন্দোলনকে থেকে অন্য ফায়দা লুটতে চায়, তারা ঘোলা পানির সুযোগে বড় মাছ শিকার করতে চাইছে। তবে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গায়ের জোরে দমন করা যায় না। আলাপ-আলোচনা করেই তাদের বঞ্চনার ক্ষতে প্রলেপ বুলাতে হবে, তাদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্যোগ নিতে হবে।
দেরিতে হলেও সরকার সে উদ্যোগ নিয়েছে। সেই চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে। যে পুলিশ বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা চালিয়ে তাদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তারা অবশ্যই সরকারের শুভাকাঙ্খী নয়। পাশাপাশি যারা উপাচার্যের বাসায় হামলা চালিয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সতর্ক থাকতে হবে, পানি যেন কেউ ঘোলা করার সুযোগ না পায়। আর কোনো অপশক্তি যেন সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার সুযোগ না পায়।
৯ এপ্রিল, ২০১৮
এইচআর/পিআর