দেশজুড়ে

প্লাস্টিকে কমছে মৃৎশিল্পীর কদর

আসছে পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের এই দিনকে ঘিরে দেশের আনাচে কানাচে বসে বৈশাখী মেলা। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম-গঞ্জের বৈশাখী মেলায় মাটির তৈরি ছোট-বড় গরু, হাতি আর ঘোড়াসহ বিভিন্ন খেলনার পসরা সাজিয়ে বসতেন দোকানীরা। আবহমান বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির বৈশাখী মেলা থেকে শিশুদের জন্য কেনা হতো এসব খেলনা সামগ্রী। গ্রাম কিংবা শহুরে মেলাগুলোতে সমান তালে মাটির তৈরি খেলনা সামগ্রীর চাহিদা ছিল। তবে গেল কয়েক বছর ধরে পাইকারদের তরফ থেকে মাটির তৈরি খেলনার জন্য মৃৎশিল্পীদের উপর কোনো চাপ নেই। এর কারণ হিসেবে প্লাস্টিকের পণ্যকেই দায়ী করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৃৎশিল্পীরা। তাদের দাবি, প্লাস্টিক পণ্যের কারণে মাটির জিনিস এখন আর কেউ কিনতে চায় না।

Advertisement

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের ভাদুঘর গ্রামের পালপাড়ার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা সবকিছুই মৃৎশিল্পকে ঘিরে। তিতাস নদী ও বিল থেকে তুলে আনা এঁটেল মাটি দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী বানান তারা। এসব মাটির সামগ্রী বিক্রি করেই চলে তাদের সংসার জীবন। তবে কালের আবর্তে মৃৎশিল্পের চাহিদা কমতে থাকায় খুব একটা ভালো নেই পালপাড়ার বাসিন্দারা। দুঃখ-দুর্দশায় কাটছে তাদের জীবন। অনেকেই এখন পূর্ব-পুরুষের পেশা পরিবর্তন করছেন। বর্তমানে কেবল ১০ থেকে ১৫টি পরিবারই এই মৃৎশিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। তবে পাইকারদের চাহিদা না থাকায় এরা কেউই এখন আর বৈশাখী মেলার জন্য মাটির খেলনা সামগ্রী তৈরি করেন না।

পালপাড়ার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মৃৎশিল্পী হরিমণ পালের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। শনিবার দুপুরে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, জন্মের পর থেকেই বাপ-দাদাদের এ পেশায় (মৃৎশিল্প) আছি। আগে মাটির জিনিসের প্রচুর চাহিদা ছিল, তখন হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে খেলনাসহ অনেক জিনিসপত্র বানিয়েছি। কিন্তু এখন প্লাস্টিক সামগ্রীর কারণে দিন দিন মাটির জিনিসের কদর কমছে। এখন শুধুমাত্র মিষ্টির দোকানের জন্য দইয়ের পাতিল ও গ্লাস বানাই।

পালপাড়ার গৃহবধূ শুক্লা রাণী পাল জাগো নিউজকে বলেন, বিয়ের পর থেকেই মাটির জিনিসপত্র বানানোর কাজ করছি। এখন আমার স্বামী এ কাজ ছেড়ে কৃষি কাজ করেন। বর্তমানে আমি আর আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি মিলে টুকটাক মাটির জিনিসপত্র বানাই। আগে বৈশাখী মেলা উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা এসে অর্ডার দিয়ে যেতো। তখন দিন-রাত খেটে পাইকারদের অর্ডার ডেলিভারি দিতাম। কিন্তু প্লাস্টিকের খেলনার কারণে এখন আর মাটির খেলনা চলে না। মিষ্টির দোকানের জন্য টুকটাক কাজ করে এখন কোনো রকমে খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি।

Advertisement

বাড়ির আঙিনায় মাটির তৈরি দইয়ের গ্লাস রোদে শুকাচ্ছিলেন দীলিপ পাল। তিনিও প্লাস্টিক পণ্যকে দায়ী করে বলেন, ৫৫ বছর ধরে আমি এ কাজ করছি। আগে বৈশাখী মেলার জন্য গরু, হাতি-ঘোড়া, ব্যাংক ও পুতুলসহ অনেক খেলনা সামগ্রী বানাতাম। কিন্তু চাহিদা না থাকায় এখন আর এসব বানাই না। দিন যত যাচ্ছে মাটির জিনিসের কদরও তত কমছে। মিষ্টির দোকানগুলোতে চাহিদা থাকায় আমরা এখনও টিকে আছি।

পালপাড়ার আরেক মৃৎশিল্পী সুভাষ পাল জাগো নিউজকে বলেন, শুধুমাত্র মিষ্টির দোকানগুলোর জন্য দইয়ের গ্লাস ও পাতিল বানাই। তিন থেকে চারদিন খেটে বানানো এক হাজার দইয়ের গ্লাস চার হাজার টাকা ও পাতিল পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করি। মাটি তোলার জন্য শ্রমিকের মজুরিসহ সব খরচ মিটিয়ে যা থাকে তাতে কোনো রকম সংসার চলে।

প্লাস্টিক সামগ্রীর কারণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৃৎশিল্প। আবহমান বাংলার এ ঐহিত্যবাহী শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনই কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ না নিলে একটা সময় ধ্বংস হয়ে যাবে এ শিল্প।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বৈশাখী উৎসবের আয়োজক সংগঠন সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, একটা সময় বৈশাখী মেলায় পালপাড়া থেকে মাটির তৈরি প্রচুর জিনিসপত্র আসত। গেল বছরের মেলায়ও কিছু স্টল ছিল। প্লাস্টিকের কারণে দিন দিন মাটির জিনিসের চাহিদা কমে যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি আমরা নিজেরা যদি মৃৎশিল্পকে লালন না করি তাহলে ঐতিহ্যের ধারক এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বলেন, জামদানি শাড়ি ও শীতল পাটি যেমন বাংলাদেশের ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে তেমনি মৃৎশিল্পকে যদি আমরা লালন করি তাহলে এটিও ইউনেস্কোর স্বীকিৃতির মাধ্যমে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে।

Advertisement

আরএ/পিআর