কিশোর বয়সে ড. জেকিল ও মিস্টার হাইডের কাহিনী পড়েছিলাম। অনেকেই পড়েছেন। বিশ্বসাহিত্য ভাণ্ডারের একটি সুপরিচিত উপন্যাস ‘স্ট্রেঞ্জ কেস অফ ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’। কাহিনীটি সকলেরই জানা। তবু একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি।
Advertisement
সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ভদ্র সভ্য মানুষ ড. জেকিল। গোপনে ওষুধ পান করে তিনি কখনও কখনও হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত চরিত্রের দুর্বৃত্ত লম্পট মিস্টার হাইড। একই মানুষের ভিতরে দুটি ভিন্ন চরিত্রের বসবাস। একজন সমাজের সুসভ্য, শিষ্টাচার মেনে চলা, সর্বজন শ্রদ্ধেয়। আর অন্যজন ভয়ংকর, খুনি, হিংস্র, নারী নির্যাতক।
বস্তুত মানুষের দ্বৈত সত্তাকে বিশ্লেষণ করার জন্যই এই বই। রবার্ট লুই স্টিভেনসন এই থ্রিলারধর্মী উপন্যাসটি লিখেছিলেন ঊনবিংশ শতকে। এই একুশ শতকে যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে মানুষের ইনবক্স ও আউটবক্স চরিত্র নিয়েও আরেকটি উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতেন অনায়াসে।
সম্প্রতি ইনবক্স চ্যাটিং নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম বেশ সরগরম। দেখা যাচ্ছে সমাজে যিনি রুচিবান সুশীল হিসেবে পরিচিত, যিনি অনেকের কাছে অনুকরণীয়, যিনি ফেসবুকে মানবাধিকার নিয়ে বেশ সোচ্চার, যিনি অন্যের স্ট্যাটাসে রুচিবান মন্তব্য দেওয়ার জন্য প্রশংসিত তিনিই মধ্যরাতে ইনবক্স চ্যাটিংয়ে ভিন্নরূপে আবির্ভূত হচ্ছেন।
Advertisement
ইনবক্সে কোন নারীর সঙ্গে যদি আলাপ করতে মেতে ওঠেন তাহলে দেখা যায় অনেক ড. জেকিলই পরিণত হচ্ছেন মিস্টার হাইডে। তারা বিনা সংকোচে অশালীন কথা-বার্তা লিখছেন। কুপ্রস্তাব দিচ্ছেন। লং ড্রাইভে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। এমনকি যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাবও দিচ্ছেন। আর এসব প্রস্তাব তারা দিচ্ছেন পরিচিতি, অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত নারীদেরও।
নিজে বিবাহিত না অবিবাহিত, নারীটি বিবাহিত না অবিবাহিত, ইচ্ছুক না অনিচ্ছুক কিছুই তারা বিবেচনা করছেন না। কেন এমনটি হচ্ছে? কেন নিরালায় একজন নারীর সঙ্গে আলাপের সুযোগ পেলেই (হোক তা ভার্চুয়াল) তাদের মধ্যে কুপ্রবৃত্তি জেগে উঠছে? তবে কি অনেক পুরুষের মনের ভিতরেই একজন লম্পট বা ধর্ষক বাস করে? যারা ভদ্রতার মুখোশ পরে সমাজে চলাফেরা করে বটে কিন্তু অনুকূল পরিস্থিতি পেলেই স্বরূপ ধারণ করে! একজন নারীর সঙ্গে একজন পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে অবশ্যই। তারা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধু হয়ে থাকেন তাহলে তারা কখনও কখনও ইনবক্সে চ্যাটিংও করতে পারেন। এই আলাপচারিতা হবে তাদের দুজনার মধ্যকার সম্পর্কের গভীরতার ভিত্তিতে। নারী-পুরুষ যিনিই হোন তিনি অনেক রকম প্রস্তাব দিতে পারেন অথবা আকাঙ্খার কথা ব্যক্তও করতে পারেন। কিন্তু সবটাই হওয়া প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থা, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব কিংবা সম্মতির ভিত্তিতে।
দীর্ঘদিন আলাপের পর পরস্পরের আগ্রহের ভিত্তিতে তারা লং ড্রাইভ, শর্ট ড্রাইভ ও অনেক রকম ড্রাইভে যেতে পারেন। কিন্তু যেখানে একপক্ষ গররাজি বা বিব্রত বোধ করছে বা মনে করছে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে সেখানে কেন এসব অশালীন প্রস্তাব দেওয়ার প্রবণতা?
আমার এক পরিচিত নারী তার ইনবক্সে পাঠানো কয়েকজন পুরুষের চ্যাটিংয়ের স্ক্রিনশট পাঠালেন। তাদের প্রত্যেকেই আমার বিশেষ পরিচিত। তাদের স্ত্রী ও সন্তানরাও আমার পরিচিত। মেয়েটি অবিবাহিত, কর্মজীবী। এই লোকগুলো তারই পেশার বড়ভাই। সামনাসামনি দেখা হলে এরা প্রত্যেকেই ভদ্রতার অবতার। অথচ আড়ালে ইনবক্সে কন্যার বয়সী বা ছোটবোনের বয়সী এই মেয়েটিকে কুপ্রস্তাব ও অশালীন কথাবার্তা বলতে তাদের বাঁধছে না।
Advertisement
মেয়েটি এদের ব্লকও করতে পারে না, স্ক্রিনশটও প্রকাশ করতে পারে না। কারণ কেউ হয়তো তার সহকর্মী, অন্য কেউ একই পেশার। প্রতিবাদ করলে এই পেশায় টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে তার জন্য। আমার ব্যক্তিগতভাবে ইচ্ছা করছিল এই বেল্লিকগুলোকে জুতাপেটা করি। কিন্তু আমারও সেই ক্ষমতা নেই।
আসল কথা হলো একজন মানুষকে (তিনি নারী পুরুষ তৃতীয় লিঙ্গ বা যাই হোন না কেন) মানুষ হিসেবে সম্মান করার চর্চা সমাজে ও পরিবারে থাকতে হবে। অন্য মানুষের অধিকার, ইচ্ছা অনিচ্ছাকে সম্মান করতে হবে। এই সম্মান করার ধারণাটি শুধু মুখে মুখে, সেমিনার, টকশোতে বা স্ট্যাটাস, লাইক কমেন্টে থাকলে চলবে না। এটি একেবারে চেতনে ও মননে প্রোথিত থাকতে হবে দৃঢ়ভাবে।
কেউ যদি অন্তরের ভিতরে অন্য মানুষকে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে, প্রেম করতে চাওয়ার বা না চাওয়ার অধিকারকে স্বীকার করে তাহলে সে কিছুতেই কাউকে হয়রানি বা বিব্রত করতে পারে না। কুপ্রস্তাবও দিতে পারে না। ইনবক্সে নারীদের হয়রানি করা পুরুষের সঙ্গে রাস্তাঘাটে নারীদের উত্ত্যক্ত করা বখাটের মানসিকতার মৌলিক কোন তফাৎ নেই। তারা মনে করে একজনকে হয়রানি বা উত্ত্যক্ত করে সে মজা পাচ্ছে এবং বিশ্বে তার এই মজা পাওয়াটাই চূড়ান্ত সত্য।
একজন মানুষকে হয়রানি করা যে মোটেও মজার বিষয় নয় বরং গুরুতর শয়তানি এ বোধটাই তাদের মধ্যে কাজ করে না। এই ধরনের বিকৃতরুচির পুরুষরা মনে করে কোন নারীকে সে ইচ্ছা করলেই হয়রানি করতে পারে, সুযোগ বুঝে অশালীন কথা বলতে পারে, আরও বেশি সুযোগ পেলে ধর্ষণও করতে পারে। বস্তুত এরা নারীকে কোনরকম সম্মান করে না বলেই এই ধরনের কুকার্যগুলো অবলীলায় করে।
এইসব বান্দরের বা সাধুভাষায় বললে মর্কটের হাতে প্রযুক্তি পড়ায় তারা যা খুশি তাই করছে। শৈশব থেকে পারিবারিক ও বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাটা এমন হওয়া উচিত যেন একটি মানুষ অপর মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শেখে। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছাকে মূল্য দিতে শেখে। এবং কাউকে হয়রানি করার আগে নিজেকে সংযত রাখতে শেখে।
এ জন্য যেমন হয়রানিরোধক আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার তেমনি আচরণগত সুশিক্ষারও দরকার। তাহলে আর বাইরের ড. জেকিলরা ইনবক্সে মিস্টার হাইডরূপে আবির্ভূত হবে না।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস