মতামত

ধর্ষণ নেই যেখানে

কী অদ্ভুত শিরোনাম, তাই না? ধর্ষণ নেই যেখানে! কোন্খানে? কোন্খানে ধর্ষণ নেই? হাঠেমাঠেঘাটেপথে বাজারে স্কুলে মাদ্রাসায় মসজিদে মন্দিরে প্যাগোডায় গীর্জায় পোড়োবাড়িতে নয়াবাড়িতে কারখানায় অফিসে ঘরে চিলোকোঠায় বেজমেন্টে সিঁড়িতে ছাদে বেডরুমে কিচেনে ড্রয়িংরুমে টয়লেটে মেঝেতে বিছানায় দোলনায় কোলে কাঁখে পিঠে বুকে মুখে জিহ্বায় চোখে এবং অবশ্যই মগজে।

Advertisement

ধর্ষণ প্রবৃত্তি এবং একই সাথে ধর্ষণের শিকার হওয়ার আতংক বাস করে মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠের মতো। ধর্ষণ প্রবৃত্তি থাকলেই ধর্ষণের শিকার হওয়ার আতংক থাকবে। এই সত্যকে শাক দিয়ে ঢেকে পোশাক-ধর্ম-আইন-আচার-ভর্তা-ভাজি যা কিছু টেনে আনুন না কেন, ফলাফল একটাই। ধর্ষণ রয়ে যাবে সবখানে। সে আগুন ছড়িয়ে যাবে সবখানে সবখানে সবখানে...

বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ এভাবে কি দেখা যায়- এমন এক স্থান, যেখানে ধর্ষক-ধর্ষিতার বালাই নেই, কেননা ধর্ষণ কাকে বলে সেখানকার মানুষ জানেই না? খুব কৌতূহলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তথ্যজালে একটু ঝাকি দিতেই জেনে গেলাম, এরকম অবাস্তব স্থান বাস্তবেই নাকি আছে। এও কী সম্ভব গোলাম হোসেন? নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না, কানকে না, মনকে তো নয়ই। কেননা, জন্মাবধি জেনে আসছি ধর্ষণ একটি স্বাভাবিক ঘটনা, প্রকৃতিগতভাবে পুরুষ মানুষের শরীরে ধর্ষণ-প্রবৃত্তি থাকতেই পারে বিধায় ধর্ষণের জন্য পুরুষ দায়ী নয় বলে ধর্ষণের শিকারকেই দায়ী হতে হবে। আর তাই, ধর্ষণ পরবর্তী সামাজিক নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে, ধর্ষককে কঠোর শাস্তি দিতে হবে বলে ফাটা গলায় মধ্যম বা নিন্ম -মধ্যম, বেশির ভাগ সময় নিন্ম ডেসিবেলের আওয়াজ তুলে উচ্চ এবং জোরালো আওয়াজে প্রশ্ন তুলতে হয় ধর্ষণের কারণ বিষয়ক হ্যানোত্যানো, ধর্ষিতার কাপড় দৈর্ঘ্য-প্রস্থে-আড়ে-আবডালে কত ছিল কি ছিল না, চুল দেখা যেত কি যেত না, স্যান্ডেল না হাইহিল, সানগ্লাস না চশমা, হাসি না কাঁশি, হারমোনিকা না বাঁশি।

যা বলতে চাইছিলাম, সেই কথাতেই বরং আসি। এই ধরাধামে এমন এক জনগোষ্ঠী বিরাজমান, যারা ধর্ষণ বা রেপ বা এরকম কোন শব্দের সাথে পরিচিত নয়, জানেই না ধর্ষণ কাকে বলে। নানান ভাবে বুঝিয়ে বলে জানতে চাওয়া হয়েছে, ধর্ষণ কি? সেই মানুষগুলো উল্টো প্রশ্ন করেছে, ধর্ষণ কি? কাকে বলে? খায় না মাথায় দেয়?

Advertisement

জায়গাটার নাম বনটক। এখানকার অধিবাসীদের বলা হয় বায়ানিহান। বনটক এসেছে বান এবং টাক শব্দ থেকে। বান শব্দের অর্থ ‘নিতম্ব’ এবং টাক শব্দের অর্থ ‘উপরে’। দু’টি মিলে হয় ‘পাহাড়’ বা বনটক। ফিলিপাইনের পাহাড়ি প্রদেশসমূহ বেনগুয়েট, বনটক, ইফুগাও, কালিংগা-আপাইয়াও-তে ধর্ষণে অক্ষম বায়ানিহানদের বাস। বনটকের কথা বলছি কেবল, কেননা বায়ানিহানদের সম্বন্ধে জানতে গিয়ে জানলাম, বিবিসি একটি তথ্যচিত্রের খবর দিয়েছে বনটকের বায়ানিহানদের উপর, নাম বনটক, রেপলেস বা ওয়ালাং রেইপ সা বনটক।

বনটকবাসীরা কি রোমান্সহীন? জানা গেছে, বনটকে পুরুষরা কোন নারীর মন জয় করতে চাইলে জ্বালানি কাঠ উপহার দেয়। এর অর্থ হচ্ছে, আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি। এখানকার নারী-পুরুষ নাকি প্রকাশ্যে পরস্পরের হাত ধরা বা চুমু খাওয়ার বিষয়টি জানেই না।

আবার অপ্রকাশ্যেও যে নারীর শরীরের দখল নিতে জোর খাটানো যায়, সে তথ্যও জানা নেই এদের। এরা কেবল জানে, যে যাকে ভালবাসে, সে তাকেই ভালবাসে। এই ভালবাসা মানে কি? একে অপরকে সমস্যা সমাধানে সাহায্য করা। এখনো এখানকার নারীরা অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ প্রদর্শন করে, তাতে কারোর কিছু এসে যায় না।

পুরনো দিনের বনটকবাসীদের একটি ছবি দেখলাম। ১৯৩০ সালে তোলা আলোকচিত্রটির উপরে আকাশ, পেছনে পাহাড়, নদী বা লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে কেবলমাত্র কোমরে কাপড় পেঁচানো নারী-পুরুষ দল বেঁধে হাতে হাত ধরে মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে সামনে। ছবিটার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ন্যাকেড এন্ড নট আসকিং ফর ইট। এরা উলঙ্গ কিন্তু এ নিয়ে এদের কোন মাথা ব্যথা নেই। গোলাম হোসেন, ওদের তথাকথিত মাথা নেই তাই ব্যথা নেই। কিন্তু বাকিদের তো আছে।

Advertisement

এই ছবির মানুষগুলোর সরল আনন্দ চেখে দেখার অনুভূতি ধর্ষণ জ্বরে থরথর কম্পমান সমাজের কারো নেই। বাজি ধরে বলতে পারি, পরিচিত চোখগুলো উপরের আকাশ, পেছনের পাহাড়, নারী-পুরুষের হাসিভরা মুখ একটুও দেখবে না। নারীদের অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ চোখে পড়বে কেবল। জেগে উঠবে অনুভূতি এবং এর জন্য অবশ্যই দায়ী হবে নারীরা। কেন রে তোরা কাপড় পরিস্ নি? অথচ, এই সমাজের এই নারী এবং পুরুষরা নাকি জানেই না, ধর্ষণ নামক একটি অপকর্ম দাপটের সাথে শাসন করছে বিশ্ব সমাজ, নারী-পুরুষের মনোজগত!

তথ্যচিত্রটির ট্রেইলার পেলাম ইউটিউবে। দুই ফিলিপিনো নারী, দুজনই যৌন সন্ত্রাসের শিকার, দুজনই এমন এক ইউটোপিয়া খুঁজছিলেন, যেখানে কোন নারীকে যৌন সন্ত্রাসের শিকার হতে হয় না। বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী জুন প্রিল-ব্রেট বহু বছর ধরে বনটকে বাস করেছিলেন, তিনিই সেই দুই নারীকে সন্ধান দেন বনটকের। তারা বনটক গেলেন। তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য ওখানকার মানুষগুলোর কথা রেকর্ড করলেন।

মানুষগুলো জানাল, তাদের পুরনো দিনগুলো সত্যিই ধর্ষণহীন ছিল। শিশুর মতো জীবন কাটাতো বড়রাও। একে অপরকে ভালবাসতো। গায়ে কাপড় না থাকলেও ধর্ষণ করতো না, ভালবাসতো। কিন্তু এখন নাকি দিন আর আগের মতো নেই। এখন বনটকবাসীরা পোশাক পরে। কিন্তু তরুণরা নাকি অশুদ্ধ চিন্তা শিখে ফেলছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই খারাপ হচ্ছে অবস্থা।

কী বুঝলে গোলাম হোসেন? এতক্ষণ যা বললাম, তা আসলে ছিল। এখন নেই। এখন ‘ধর্ষণ নেই যেখানে’ টাইপের শিরোনাম নিজেই অবাস্তব, তাই না?

“সা বুনডক নং বুহাই, পাটুলয় আং পাগলালাকবায়...”জীবনের পাহাড়েচল যাই আহারেঅন্তহীন যাত্রায়...

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/আরআইপি