যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, রাশিয়া তালেবানদের সহায়তা করে আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে। এমনকি তালেবানকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন। তবে পরস্পরের শক্র রাশিয়া এবং তালেবান উভয়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
Advertisement
গত মার্চে বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে আফগানিস্তানে মার্কিন কমান্ডার জেনারেল জন নিকলসন অভিযোগ করে বলেন, তাজিকিস্তানের সীমান্ত এলাকা থেকে তালেবানের কাছে রাশিয়ান অস্ত্র চোরাচালান হয়ে আসছে।
তার অভিযোগ, এসব অস্ত্র আমরা সদরদপ্তরেও এনেছি। আফগান নেতারা আমাদের দিয়েছেন এবং তারা বলেছেন যে, রাশিয়ানরাই তালেবানদের দিয়েছে। কয়েকজন আফগান পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তালেবানদের কাছে রাশিয়ান সরঞ্জামের মধ্যে রাতের চশমা, ভারী মেশিনগান আর ছোট অস্ত্রও রয়েছে।
গত এক বছর ধরেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ করে আসছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল নিকলসন রাশিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ করেন যে, তালেবানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। এরপর বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা এই অভিযোগ তুলেছেন।
Advertisement
তবে গত বছরের মে মাসে মার্কিন সিনেটে দেয়া একটি সাক্ষ্যে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভিনসেন্ট আর স্টুয়ার্ড বলেছেন, অস্ত্র সরবরাহ বা অর্থ লেনদেনের বাস্তব কোন তথ্যপ্রমাণ আমি পাইনি।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস ম্যাটিস গত অক্টোবরে বলেন, তালেবানকে রাশিয়ার সাহায্য করার বিষয়ে আমি আরো তথ্যপ্রমাণ দেখতে চাই। যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে, তা থেকে পরিষ্কার কিছু বোঝা যায় না। ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টোলটেনবার্গ বলেন, এসব দাবির সপক্ষে আমরা এখনো কোন প্রমাণ পাইনি বা নিশ্চিত তথ্য পাইনি। আর এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে তাজিকিস্তান।
এই দাবির বিষয়ে আফগান কর্মকর্তারাও বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন। কয়েকজন আফগান কর্মকর্তা দাবি করেছেন যে, তালেবানদের রাশিয়া সাহায্য করছে।
কিন্তু আফগানিস্তানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মুখপাত্র গত মে মাসে বলেন, এখনো এর পক্ষে কোন প্রমাণ নেই। গত অক্টোবরে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিও দাবি করেন, রাশিয়ানদের কাছ থেকে অস্ত্র পাচ্ছে তালেবান। কিন্তু পরের মাসেই তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এই দাবিকে গুজব বলে নাকচ করে দেন।
Advertisement
মস্কো বলছে, আফগানিস্তানে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলেছে। তালেবানরা দাবি করেছে, তারা কোনও দেশ থেকেই কোন সামরিক সহায়তা পায়না।
তালেবানকে সামরিক কোন সাহায্য সহযোগিতা দেয়ার কথা নাকচ করেছে রাশিয়া, তবে তারা স্বীকার করেছে যে, তাদের মধ্যে যোগাযোগ আছে। তালেবান সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০০১ সাল থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। গত তিন বছরে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে।
অনেক তালেবান নেতা আশা করছিলেন যে, রাশিয়া থেকে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বা এমন অস্ত্র পাবে, যা হয়তো পুরো যুদ্ধে তাদের অবস্থানকে বদলে দেবে। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল আশির দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগানদের লড়াইয়ের সময়। কিন্তু সেটা হয়তো হয়নি কারণ এ ধরণের অস্ত্রের উৎস সহজেই সনাক্ত করা যায়। আর রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখনো ততটা খারাপ দিকে মোড় নেয়নি।
তালেবানের জন্য অস্ত্রের চেয়েও বেশি দরকার একটি আঞ্চলিক শক্তির নৈতিক আর রাজনৈতিক সমর্থন। হালকা অস্ত্র হয়তো কালোবাজারেও কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু এই সমর্থন তো পাওয়া যাবে না। তালেবান কূটনীতিকরা চীন আর ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে।
রাশিয়া-তালেবান সম্পর্কের তিনটা বড় কারণ আছে। প্রথম, রাশিয়ান কর্মকর্তারা বলছেন, তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার প্রধান কারণ হলো আফগানিস্তানে রাশিয়ান নাগরিক আর রাজনৈতিক অফিসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের ইসলামিক স্টেট গ্রুপের বিস্তারের কারণে মস্কোর আশংকা তৈরি হয়েছে যে, তারা মধ্য এশিয়া আর রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে আফগান তালেবান এবং তারা প্রতিবেশী দেশগুলোকে আশ্বস্ত করেছে যে, তাদের সশস্ত্র লড়াই আফগানিস্তানের মধ্যেই থাকবে। রাশিয়া জানিয়েছে যে, আফগানিস্তানে আইএস আরো শক্তিশালী হলে তারা সিরিয়ার মতো করে সেখানেও হস্তক্ষেপ করতে পারে।
তৃতীয়ত, রাশিয়ান কর্মকর্তারা বলছেন, আফগান সংকটের সমাধান সামরিক পথে নয়, রাজনৈতিক পথেই হওয়া উচিত। তালেবানকে শান্তির পথে আনতে আলোচনার জন্যই তাদের এই যোগাযোগ বলে মস্কো দাবি করেছে।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতির প্রভাব ইউক্রেন, সিরিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়তে শুরু করেছে। তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোকে খানিকটা অবজ্ঞাই করছে মস্কো।
আবার ওয়াশিংটন আর ইসলামাবাদের মধ্যে যেমন দূরত্ব বাড়ছে, রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক আর সামরিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। আর এই সবগুলো শক্তিরই আফগানিস্তানে নিজেদের স্বার্থ রয়েছে। ফলে অনেকের মধ্যে এই আশংকাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তান আবারো হয়তো আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর খেলার মাঝে পড়তে যাচ্ছে।
টিটিএন/জেআইএম