দেশজুড়ে

১৩২ ঘর নির্মাণ, প্রতি ঘরে ৪০ হাজার টাকা পকেটে

যশোরের বাঘারপাড়ায় আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের অধীনে ১৩২টি ঘর নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প থেকে লুটপাটের জন্য ঘর নির্মাণে প্ল্যান, ডিজাইন প্রাক্কলন মোতাবেক গুণগত মান বজায় রাখা হয়নি।

Advertisement

এছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী। প্রতি ঘর ১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণের কথা থাকলেও তা ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকায় সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রতি ঘরে ৪০ হাজার টাকা করে পকেটে পুরিয়েছেন কর্মকর্তারা।

এভাবে অনিয়মের মাধ্যমে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকার প্রকল্পে প্রায় অর্ধকোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ‘জমি আছে ঘর নেই, তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় বাঘারপাড়ায় এই গৃহনির্মাণ করা হচ্ছে।

বাঘারপাড়ার রায়পুর ইউনিয়নের শালবরাট গ্রামের শিখা রানীর জমিতে এই প্রকল্পের আওতায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তার স্বামী কার্তিকের অভিযোগ, বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে অযোগ্য ইটের খোয়া, নিম্নমানের ইট ও দুর্বল কাঠের বাতা। আবার উল্টো নির্মাণের মালামাল আনতে ও বিভিন্ন মালামাল কিনতে তারও সাত থেকে আট হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।

Advertisement

একই গ্রামের পুষ্প রানীর জমিতেও প্রকল্পের আওতায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তার ছেলে বিধান জানান, বিভিন্ন সময় ইট, বালু, টিন, কাঠের বাতা, টিনের স্ক্রু, পলিথিন কেনা ও পরিবহন খরচ বাবদ ব্যয় হয়েছে আট হাজার টাকার মতো। একই ইউনিয়নের সদুল্যাপুর গ্রামের চিয়ারুন, নবিরন, মনোয়ারা তাদেরও খরচ হয়েছে ছয় থেকে সাত হাজার টাকার মতো।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ২৭৫ বর্গফুটের ঘর নির্মাণে এক নম্বর ইটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দুই নম্বর ইট। দশমিক ৩৬ এমএম’র পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দশমিক ৩২ এমএম’র ঢেউটিন। নকশায় ফাউন্ডেশন ঢালাইয়ের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। মেঝে ও পিলারে ব্যবহার হয়েছে একেবারেই নিম্নমানের খোয়া ও চিপ। পিলারও দেয়া হয়েছে একটি কম। মাত্র তিনটি রডে বানানো হয়েছে পিলার। ছয়টির বদলে জানালা হয়েছে দুটি। ঘরের বেড়া ও চালে শাল, গর্জন, জারুল, কড়াই, শিশু, তাল, পিতরাজ, দেবদারু বা আকাশমনি কাঠ ব্যবহারের কথা। কিন্তু শুধুমাত্র দেবদারু আর নিম্নমানের মেহগনি ব্যবহার করা হয়েছে। আর তারকাটা, পেরেক, তার, কব্জা, ছিটকানি, স্ক্রু, ওয়াশার, মেঝের রঙ এসব কিছুই নেয়া হয়েছে উপকারভোগীর কাছ থেকে। মালামাল আনা-নেয়ার জন্যও তাদেরকে টাকা গুনতে হয়েছে।

মালামাল সরবরাহ খরচ নিয়েছে কাজের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের অফিস সহকারী আসাদুজ্জামান। আসাদুজ্জামানের বাড়িতে ঘর নির্মাণের মালামাল রেখে উপকার ভোগীদের পরিবহন খরচ দিয়ে নিতে বাধ্য করছে। আবার ঘর নির্মাণের সময় শ্রমিকদের দুপুরের খাবারও খাওয়াতে হয়েছে উপকারভোগীদের। সবমিলিয়ে এক লাখ টাকার ঘর নির্মাণ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে শেষ করা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তত্ত্বাবধানে ‘পিআইসি’ দ্বারা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) এ ঘরগুলো নির্মাণের কথা। কিন্তু প্রকল্পের নকশা ডিজাইন ও প্রাক্কলনের তোয়াক্কা না করে গৃহহীন মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে নিজেদের ইচ্ছামতো অতি নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী দিয়ে ঘর তৈরি করা হচ্ছে। কাগজ কলমে ৫ সদস্যের পিআইসি থাকলেও আহ্বায়ক (নির্বাহী কর্মকর্তা) ছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা জানেন না কোথায় কোন কাজ হচ্ছে। নির্বাহী কর্মকর্তা নিজের ইচ্ছেমত প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন।

Advertisement

প্রকল্পের পিআইসির দায়িত্ব থাকা প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে আমার সঙ্গে নির্বাহী কর্মকর্তার কোনো কথা হয়নি। আমার জানা মতে কোনো মিটিংও হয়নি।

অপর সদস্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মেদ জানান, প্রকল্পের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এসব বিষয়ে তিনিই সবকিছু জানেন। একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কাজের মান অত্যন্ত নিম্নমানের।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম শাসসুদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অভিযোগের বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে।

তবে বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম জানিয়েছেন, অভিযোগ ওঠায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও সরেজমিন পরিদর্শন করে গেছেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

মিলন রহমান/এএম/পিআর