মতামত

কার কাছে বিচার দিব?

 

নারী হয়ে জন্মেছি। এ দোষ কি আমার? আমাকে জন্ম দিয়েছে আমার পিতামাতা। তারা কখনও আমাকে শিখায়নি নারী হয়ে জন্মেছি বলে আমি এই সমাজে অবহেলিত একজন। নারী হয়ে জন্মেছি বলে আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব কেউ নিবেনা। পরিবার শিখায়নি রাস্তায় চলতে গেলে আমার পোশাকে কারও সমস্যা হতে পারে। আমি শিখতে পারিনি আমাকে স্কুলে, কলেজে বা কর্মক্ষেত্র সবজায়গাতেই হেনস্তার শিকার হতে হবে কেবল নারী হয়েছি বলেই।

Advertisement

আমি একজন অসহায় নারী বলছি। ছোট থেকে এসব না শিখলেও বর্তমান বাংলাদেশ আমাকে এখন এসব ভাবতে বাধ্য করছে। এই দেশে এখন উন্নয়নের স্রোতে বয়ে চলেছে অনেক উন্নয়নের ধারা। কিন্তু উন্নতি আসেনি নারীর জীবনে। উন্নয়নশীল দেশে যাবার জন্য দরকার নারীর অবস্থানকে উন্নত দেখানো কিন্তু সেই নারী যখন ধর্ষণের শিকার হয় তখন তাদের জন্য নেই কোন আইন। সংবিধানে নারীর অবস্থান কী তা আমাদের জানা নেই।

বাংলাদেশের নাগরিকের যে সংজ্ঞা নির্ধারিত আছে সেখানে কোথাও বলা নেই, নারী হিসেবে আমরা নাগরিকত্বের আওতায় পড়িনা। তাহলে জানতে মন চায়, আমি যদি বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকি তাহলে এই দেশের আইন আমার জন্য প্রযোজ্য নয় কেন? আমি যদি নাগরিক হয়ে থাকি তাহলে আমার ভোটে নির্বাচিত হয়ে আপনারা কেন আমার জন্য একটি নিরাপদ সমাজ গড়ার শপথ নিবেন না? কেন এর লক্ষ্যে কাজ করবেন না?

কেন আট মাসের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও রেহাই পাচ্ছে না সমাজে বিদ্যমান কিছু পুরুষ নামের পশুর হাত থেকে? কেন তবে আজো বিচার হয়নি তনু ধর্ষণ ও হত্যার? কেন এখনও বিউটি নামক মেয়েদের যখন তখন ধর্ষণ করা যায় এবং চাইলেই হত্যা করে খোলা মাঠে ফেলে রাখা যায় বলে কিছু মানুষ বিশ্বাস করে? কে দিলো তাদেরকে এই বিশ্বাসের জোর? কোথায় পায় তারা সেই শক্তি? বিউটি নামের মেয়েটির লাশের ছবি আজকে আমার মত বাংলাদেশের সকল নারীর ছবিকে প্রতিনিধিত্ব করে।

Advertisement

অন্যদিকে বাংলাদেশের মেয়েরা এখন ফুটবল, ক্রিকেট সব খেলছে। মেয়েরা দেশে বিদেশে যাচ্ছে এবং কৃতিত্বের সাথে নিজের দেশের সম্মান নিয়ে আসছে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন ও ভারতে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হওয়া বাংলাদেশের মেয়ে ফুটবলারদের নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। একদিন এই তারকারাই বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার এমন বক্তব্য আমাদেরকে আশাবাদী করে তুলে। বাংলাদেশের নারীরা নিজেদেরকে নিয়ে গর্ব করতে চায়। বুক ফুলিয়ে দেশের জন্য লড়ে যেতে চায়। নিজের যোগ্যতায় নিজের জন্য সম্মানজনক জায়গা তৈরি করে নিতে চায়। তারা কারো কাছে দয়া চায় না। কারো দানে নিজের জীবন চালাতে চায় না।

কিন্তু কোথায় যেন তাদের এই চাওয়াটাকেই মেনে নিতে পারছে না একদল পুরুষ। আমি জানি, সমাজের সকল পুরুষ খারাপ না। কিন্তু বাস্তবতা আমাকে ভীতু করে দিচ্ছে। আমি একজন উচ্চশিক্ষিত ও সচেতন নারী বলে নিজেকে মনে করি। আমি একজন কর্মজীবী নারী যার অবদান রয়েছে এই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ায়। আমিও ট্যাক্স দেই। আমারও ভূমিকা আছে এদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। আমার মত এমন হাজারো নারীর আজ সমান তালে অবদান রেখে চলেছে সমাজের সকল ক্ষেত্রে।

আপনি নিজেও জানেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনি নিজেও গর্ব করেন এদেশের নারীর ভূমিকার। তাহলে তারা কারা যারা আপনার ভরসার জায়গাটিকে নষ্ট করে দিতে চাইছে। টলমলে করে দিতে চাইছে নারীর এগিয়ে যাওয়ার রাস্তাটিকে। তারা কারা যারা সমাজের মধ্যে অসুস্থতার চর্চাকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে?

Advertisement

আমাদের জানা নেই। তবে আমরা জানতে চাই। আমরা প্রতিরোধ দেখতে চাই। আমরা প্রতিবাদ করতে চাই সেসব পুরুষদের বিরুদ্ধে যারা বিউটির মত মেয়েকে আটকে রেখে মাসব্যাপী ধর্ষণ করে চলেছে। পালিয়ে এসেও মুক্তি পায়নি বিউটি। সারাদেশে নারী মুক্তির যে শ্লোগান, সরকারের ঘোষিত নারীবান্ধব কর্মকাণ্ড হয়তো বিউটি এবং তার বাবাকে সাহসী করে তুলেছিলো, আশান্বিত করেছিলো তাইতো তারা বিচার চাইতে গিয়েছিলো। আইনের আশ্রয় নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু বোকা পিতা জানতেন না সেসব কথার কথা।

এই সমাজ, এই বাংলাদেশ এখনও বিউটির মত লাখো নারীদেরকে নিজেদের হাতের পুতুল মনে করে। ক্ষমতা থাকলেই একজন নারীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়। ঘরে আটকে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা যায়। বিচার চাইতে গেলে পালিয়ে আসা সেই মেয়েকে আবার তুলে নিয়ে গেলেও কেউ আটকানোর শক্তি রাখে না। ধর্ষণ নয় কেবল, বিউটিদেরকে এই সমাজে বাঁচিয়ে রাখাটাও বাবুলেরা ন্যায্য মনে করে না।

জেনেছি বাবুল হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের একজন স্থানীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তির সন্তান। নারীদেরকে যখন তখন যা ইচ্ছে তা করার অধিকার সে আদায় করে নিয়েছে। স্থানীয় এমন কোন লোকের জন্ম হয়নি যে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে। দিনের পর দিন বাবুল রাস্তা ঘাটে মেয়েদের ও নারীদেরকে উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করাসহ নানা প্রকার অন্যায় ও অবিচার করে যাচ্ছে।

অবাক কাণ্ড হচ্ছে একজন বাবুলের কাছে গোটা এলাকা জিম্মি। স্থানীয় থানা পুলিশ আছে কি নেই, থাকলেও তাদের দায়িত্বটা কী সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নেই। এই ধরনের বাবুলেরা আজকে সমাজে সংখ্যায় প্রচুর। প্রতিদিনের নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান অন্তত আমাদেরকে সে কথাই বলছে। কী শিক্ষিত, কী অশিক্ষিত, শিশু, বৃদ্ধ কেউই বাদ যাচ্ছেনা ধর্ষণের হাত থেকে, উত্ত্যক্ত করা যেন থামানোই যাচ্ছে না।

কে থামাবে? আমার জন্য নিশ্চিত চলার রাস্তা কে দিবে? কে দিবে ঘরে বসে থাকলেও আমি নিরাপদ সেই আশ্বাসবাণী? আমি জানি না। তবে এইটুকু জানি, আমার প্রিয় বাংলাদেশে আজকে নারীরা আর নিরাপদ নয়। আমি নিশ্চিত নই রাস্তায় বের হয়ে নিরাপদে গৃহে ফিরতে পারবো কি না। কোন ঘটনারই বিচার হচ্ছে না। সেকি কেবল নারী বলেই?

তারমানে কী ধরে নিব, নারীদের জীবনের কোন দাম নেই এই রাষ্ট্রে? পরিবার থেকে সমাজ কোথাও নারীরা নিজেদের অবস্থানকে বুঝতে পারছে না। নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া দূরের কথা, পাল্টা তার যে কোন অর্জনের পিছনে খুঁজতে থাকে নারী হিসেবে সে কোন সুবিধা নিলো কি না।

নারীর ধর্ষণ, নির্যাতনের জন্য দায়ী করা হচ্ছে তার পোশাককে। কোন ঘটনা ঘটলেই খুঁজতে থাকে সে কেমন পোশাক পরেছিলো। কেন পুরুষটি ধর্ষণের প্রেরণা পেলো? কিন্তু কেউ বলেনা, নারীর সম্মান তার পোশাকে না তার কর্মে নির্ভর করে। ধর্ষকের ধর্ষকামী মানসিকতা পোশাক দিয়ে আটকানো যায় না। তেমন হলে আত মাসের শিশুকে ধর্ষণ করা হতো না। তনুসহ এমন আরো অনেক উদাহরণ আছে সেখানে ধর্ষণের জন্য পোশাকের কথা সামনে আনা যায় না।

কার কাছে বিচার দিব, ধর্ষকের মানসিকতাই ধর্ষণের জন্য দায়ী। একজন ধর্ষক আর একজন হত্যাকারীর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য করা যায় না। হত্যা যদি একটি অপরাধ হয় তাহলে একজন নারীকে ধর্ষণ কেন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না? কেন সুস্থ সমাজের নাগরিক হিসেবে বিউটি, তনুর পরিবার তাদের কন্যা সন্তানের ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের বিচার পাবে না?

অনেক আন্দোলন, প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। কেউই কর্ণপাত করছেন না এই একটি ইস্যুতে। তাই আমি জানিনা, আগামীকাল আমার অবস্থা আরেকজন বিউটির মত হবে কি না? বিচার চাইতে কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো? কেউ কী আছে নারীর এই অসহায়ত্বকে দূর করে একটু সাহস দেবার? কেউ কি এগিয়ে আসবে একটি নারীবান্ধব সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করতে?

লেখক : কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস