মিসেস আজাদ
Advertisement
দিনটি আজ সর্বনাশা, স্বপ্নবিনাশী। অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃস্বপ্নের নিমিষের এক ঝড় প্রিয়জনকে এপার থেকে ওপারে নিয়ে গেছে। দিয়ে গেছে এক মহাকালের ব্যবধান। এ ব্যবধানের নেপথ্যে ছিল না নিজেদের কোনো দুর্বলতা। ইসলামের নামে বিকৃত মানসিকতার জঙ্গিরা আমার সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয়কে কেড়ে নিয়েছে বোমার আঘাতে। বোমার স্প্লিন্টারের আঘাতে এদিন তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
বলছি এলিটফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের কথা।
সত্যিকারের সাহসীরা কখনও মরেন না। হাজারও সাহসী যোদ্ধার জন্ম দিয়ে যান। আমি এমনই একজন সাহসী বীরের সহধর্মিণী হিসেবে গর্ববোধ করছি। আজাদ ছিলেন সত্যিকারের সাহসী।
Advertisement
আবুল কালাম আজাদের জন্ম ১৯৭২ সালে ২৯ মার্চ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সাহাপাড়া গ্রামে। বাবা রেজাউল করিম, মা সায়েদা করিম। আজাদের ছোট ভাই ইউসুফ হাসান হিমেল।
শৈশবের শুরুটা গ্রামেই কেটেছে। চার বছর বয়সে বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় আসা তাদের। লালমাটিয়া সূর্যমুখী কিন্ডার গার্টেন স্কুলে হাতেখড়ি তার। এরপর ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। বাবা রেজাউল করিম চাকরি করতেন প্ল্যানিং কমিশনে।
ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন খেলাধুলার প্রতি প্রবল অনুরাগী। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও মনোযোগ ছিল না লেখাপড়ায়। স্বপ্ন ছিল বড় ফুটবলার হবেন। ম্যারাডোনা ছিল তার রোল মডেল। শেরে বাংলা সরকারি বয়েজ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ভর্তি হন সাভারের বিকেএসপিতে। সেখানেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন তিনি।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তার পথচলা। আজাদ বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) ট্রেনিং শেষ করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথম পোস্টিং যশোরে। এরপর বান্দরবানে।
Advertisement
বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, আন্তরিকতার সঙ্গে সিক্স বেঙ্গল ময়মনসিংহে কোয়াটার মাস্টারের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করায় তাকে মাদার অব দ্য ব্যাটালিয়ন হিসেবে ভূষিত করা হয়। সাড়ে তিন বছর পর তিনি আর্মি সদর দফতরে অ্যাডমিন উইংয়ে দায়িত্বপালন করেন। ২০০৫ সালে তিনি মিশনে যান। আইভরিকোস্ট থেকে মিশন শেষে ২০০৬ সালে সিলেট জালালাবাদ সেনানিবাসে প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি বেশি। ‘ডু অর ডাই’ মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হয়। এমন একটি কোর্স তিনি দক্ষতার সঙ্গে শেষ করেন।
২০০৯ সালে পিলখানা বিডিয়ার বিদ্রোহের পর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি ফোর্স সেখানে পাঠানো হয়েছিল। যারা পিলখানায় আটকে থাকা বিডিআর সদস্যদের উদ্ধারে কাজ করেন। সেই ফোর্সে তিনিও ছিলেন অন্যতম কমান্ডো।
২০০৯ সালে ১৯ বেঙ্গল সাভারে ফের পোস্টিং হয়। ২০১১ সালে সিরাজগঞ্জে র্যাব-১২ এর উপ-অধিনায়ক হিসেবে তিন মাস দায়িত্বপালন শেষে র্যাব সদর দফতরে যোগ দেন। ২০১৩ সালে ৭ ডিসেম্বর নতুন র্যাঙ্ক পরেন। লে. কর্নেল হিসেবে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন শুরু করেন। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর তিনি এ পদে দায়িত্বপালন করে গেছেন বিচক্ষণতা, চৌকস ও অসম সাহসিকতার সঙ্গে।
এ সময় তিনি হলি আর্টিজান, শোলাকিয়া হামলা, সোনালী ব্যাংক লুট, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, গোপীবাগের ছয় মার্ডারের তদন্ত করেন। বনশ্রীতে দুই সন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যার রহস্যও উদঘাটন করেন।
২০১৭ সালে সিলেটের আতিয়া মহলে পরিচালিত হয় জঙ্গিবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন টোয়ালাইট’। ২৫ মার্চ তিনি বিমানযোগে সেখানে উপস্থিত হন এবং সক্রিয়ভাবে অভিযানে অংশ নেন। আতিয়া মহলের জঙ্গি আস্তানা তিনি পর্যবেক্ষণ করেন। আস্তানা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে চলে আসার পর র্যাবের একজন ফোন করে জানান, একটি বোমা সেখানে বিস্ফোরিত হয়েছে। লোকজন আহত হয়েছে- এমন খবরে তিনি পুনরায় সেখানে ফিরে আসেন। আতিয়া মহলের কাছে গিয়ে দেখেন এক পুলিশ অফিসার একটি হলুদ পলিথিনের ব্যাগ লাঠি দিয়ে নাড়ছেন। লে. কর্নেল আজাদ বলতে থাকেন, ‘ডোন্ট টাচ ইট’। নাড়তে নাড়তেই বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে পুলিশের দুই অফিসারের একজন মারা যান। অপরজনও হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। জঙ্গিদের রেখে যাওয়া সেই বোমার স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয় লে. কর্নেল আজাদের বাম চোখে। জ্ঞান হারান তিনি। দ্রুত তাকে প্রথমে নেয়া হয় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। পাঁচবার কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়। পরে তাকে বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে সিলেট থেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেয়া হয়। রাখা হয় লাইভ সাপোর্টে। পরদিন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানে এশিয়ার সবচেয়ে খ্যাতনামা নিউরোলজিস্ট লি ম্যাথিউ তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি জানান, লে. কর্নেল আজাদের ব্রেন ডেড হয়ে গেছে। ক্লিনিক্যাল ডেড বলে ঘোষণা করেন তিনি। ২৯ মার্চ ঢাকায় ফেরত এনে তাকে পুনরায় সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। ৩০ মার্চ রাত ১২টা ৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
লে. কর্নেল আজাদের মন ছিল খুবই নরম ও কোমল। মানুষের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারতেন না। সাধারণ পশুপাখির কষ্টেও চরম ব্যথিত হতেন। শিশুসুলভ মন নিয়ে সবাইকে ভালোবাসতেন। সেই মানুষটি পৃথিবী ছেড়েছে সত্যি, তবে তা শারীরিক। অশরীরি আজাদ রয়ে গেছেন সবার মধ্যে।
সবটা হয়তো মানুষ জানে না, সহধর্মিণী হিসেবে আমি যা জেনেছি। তিনি নিজ জীবনের কথা বিন্দুমাত্র ভাবতেন না। পেশাগত দায়িত্বের ক্ষেত্রে তিনি বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। সর্বদা তিনি মানুষের জন্য, দেশের কল্যাণে নিজের সবটা উৎসর্গ করেছেন। ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবার মানুষ তিনি ছিলেন না। অন্যকে অনুকরণ করা নয় বরং তিনি নিজেই নিজেকে অনুসরণ করতেন। দেশের জন্য এমন কিছু করার বাসনা তিনি সব সময় পোষণ করতেন যেন চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকেন। তিনি সেটাই করেছেন। নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিয়ে তার প্রমাণ রেখেছেন।
আমার বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সেজন্য আমি সব সময় গর্ববোধ করি। দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী আমার স্বামীর জন্যও গর্ববোধ করি। আমার সন্তানদের সে পথেই চালিত করছি। যে পথে আমার স্বামী লে. কর্নেল আজাদ দেশের জন্য বিলিয়ে দিয়ে গেছেন নিজেকে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, লে. কর্নেল আজাদকে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ ঘোষণা করা হয়। তাহলে অন্তত কিছুটা হলেও আমার ও আমার সন্তানদের মানসিক কষ্টটা কমবে।
আমি জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করি। কারণ এ জঙ্গিবাদ আমাদের সোনার বাংলাকে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু তারা সেটা কোনোদিনই পারবে না। রাজাকাররা যেমন এদেশকে দখল করতে পারেনি, ঠিক তেমন-ই জঙ্গিবাদও ও কখনও পারবে না এদেশে রাজত্ব করতে। আমার বিশ্বাস সরকার, র্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত চেষ্টায় জঙ্গিবাদের শিকড় উপড়ে ফেলা হবে। সেদিনই এদেশের মানুষ ও জাতির কল্যাণ হবে। সেদিনই আমার স্বামীর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। আমরা স্বজনহারারা বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারব।
সবার প্রতি আমার অনুরোধ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সন্তানদের প্রতি নজর দিন, যাতে জঙ্গিবাদে কেউ জড়িয়ে না পড়ে। আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। একজন ভালো মানুষই কেবল উপহার দিতে পারে একটি সুন্দর দেশ, সুন্দর জাতি।
জেইউ/এমএআর/আরআইপি