আন্তর্জাতিক

ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের যে মূল্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ

থেঁতলানো হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, মাটির স্তুপের পাশে উবু হয়ে বসে আছেন জুলেখা। জম্মু এবং কাশ্মিরের একেবারে উত্তরে চুরন্দা গ্রামের একটি দৃশ্য এটি। যে স্তুপের পাশে জুলেখা বসেছিলেন সেটি একসময় তার ঘর ছিল, মাটির ঘর। চুরন্দা গ্রামটির অবস্থান পাহাড়ের উপর। আর পাহাড়টা পেরুলেই, হেঁটে যাওয়ার দূরত্বেই, রয়েছে নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি)। হেঁটে যাওয়ার দূরত্বে হলেও সেখানে যাওয়ার সাহস অবশ্য কেউ করে না।

Advertisement

ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ২৫২ কিলোমিটার, এর মধ্যে এলওসির দৈর্ঘ্য ৭৬৭ কিলোমিটার; যা জম্মু ও কাশ্মিরের ভেতর দিয়ে গেছে ভারত পাকিস্তানকে বিভক্ত করে।

এলওসির দু’পাশেই দু’দেশের সেনাবাহিনী যেসব সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত তা তাকালেই দেখা যায়। সৈন্যদেরও দেখা যায় সুরক্ষিত বাংকারগুলোর ভেতর থেকে কড়া দৃষ্টি রাখছেন। যে ভূখণ্ডের নিরাপত্তায় তারা নিয়োজিত সেদিকে কোনো কিছু নড়চড়া দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে গুলি করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন তারা।

৪৮ বছর বয়সী জুলেখা যে ধ্বংসস্তুপের পাশে বসে আছেন সেখানে তার ঘর ছিল চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ওই দিন সীমান্তের ও পাশ থেকে ছোড়া একটি মর্টার শেল বিস্ফোরণে তার ঘরটি শেষ হয়ে যায়। জুলেখা নিজে আহতও হন।

Advertisement

১৯ ফেব্রুয়ারি ভারত-পাকিস্তানের এলওসিতে দু’দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হয়েছে তাতে যে তিনজন আহত হন জুলেখা তাদেরই একজন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এতে শুধু গোলাগুলিই হয়নি, মর্টার শেলও ছুড়েছে দু’পক্ষ। এলওসিতে এমন যুদ্ধ স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও সীমান্তের পাশেই যে গ্রামের অবস্থান, গুলি ও মর্টার শেল থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য ওই গ্রামের মানুষদের কিছুই নেই।

এলওসিতে এখন যে উত্তেজনা চলছে তার শুরু ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় উত্তর কাশ্মিরের উরির একটি সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ ভারতীয় সেনা নিহত হন। ওই হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিরা পাকিস্তানি বলেই বিশ্বাস করা হয়। উরির ওই হামলা এমন এক সময়ে সংঘটিত হয়েছিল, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে জঙ্গি নেতা (মিলিট্যান্ট লিডার) বোরহান ওয়ানি ও ১০০ বেসামরিক নাগরিক নিহেতর প্রতিবাদে উত্তাল ছিল কাশ্মির।

জুলেখা আহত হওয়ার ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ আনে। ভারতের তরফ থেকে একজন মুখপাত্র বলেন, হামলার শুরু হয় পাকিস্তানের দিক থেকে এবং ভারতীয় বাহিনী এর সমুচিত জবাব দেয়। এলওসিতে উত্তেজনা বাড়লেই দুই দেশের প্রতিরক্ষা দফতরের মুখপাত্র ও আর্মি জেনারেলরা এ ধরনের বিবৃতি দিয়ে থাকেন।

Advertisement

জুলেখার ঘরটি যেদিন মাটিতে মিশে যায় সেদিনটি কেবল সীমান্তে উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করে।

পাহাড় বেয়ে দেড় ঘণ্টা মতো হেঁচে নামলেই পড়বে তিলওয়াড়ি নামে একটি গ্রাম। সেখাকে কিছু বাড়ির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর।

সেখানে সেনাবাহিনীর যুদ্ধসরঞ্জামগুলোর দেখালেন ৪২ বছর বয়সী শোভন নজর। বললেন, কোনো গোলা বাংকারে না লাগলে সেগুলো আমাদের ঘড়-বাড়িতে এসে লাগে।

২২ ফেব্রুয়ারি নিজের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসেছিলেন নজর। হঠাৎ একটি গোলা বিস্ফোরণে বাড়ির একটা দেয়াল ধসে যায়। তার নিজের ভাষাতেই, তারা সবাই যে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছেন এটা অলৌকিক একটা বিষয়। এখন ওখানে পড়ে আছে শুধু পোড়া ইট-কাঠ। ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়েছে তার সন্তানদের বই-খাতা।

ওইদিন পাকিস্তানের দিকের মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা করা হয় গ্রামবাসীকে পালিয়ে যেতে। কারণ সেখানে হামলা শুরু হবে। সেটি শুনেছিলেন নজর।

ওই ঘোষণার পরপরই ঘরে থাকা দামি কিছু জিনিস হাতে স্রেফ নিয়ে, আর সবকিছু ফেলে যত দ্রুত সম্ভব পালিয়ে যায় গ্রামবাসী। কিন্তু নজর চুপচাপ বসেছিলেন।

‘আমি যেতে পারিনি। আমার বাড়ি, পোষা পশুটা রেখে আমি কোথায় যেতে পারতাম’?

দু’দেশের সেনারা যখনই সংঘর্ষে জড়াবে তখনই যাতে আশ্রয় নেয়া যায়, ২০০৩ সালের যুদ্ধবিরতির সম্মতি সাপেক্ষে সীমান্ত এলাকার এই গ্রামগুলোর বাসিন্দারা তাই নিজেদের জন্য মাটির বাংকার তৈরি করে রেখেছিলেন।

কংক্রিটের তৈরি বাড়ির চেয়ে এ বাংকারগুলো তাদের কিছুটা রক্ষা করে।

কিন্তু ২০০৫ সালের একটি ভূমিকম্পে এলওসির দু’পাশের সমস্ত স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। যেহেতু মাত্র দু’বছর আগেই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় দুই দেশ, তাই ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাংকারগুলো আবার তৈরির তাড়া ছিল না গ্রামবাসীর।

এরপর থেকেই যখনই নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয় গ্রামবাসীরা বলেন, আমরা সরকারকে বলে আসছি আমাদের জন্য বাংকার তৈরি করে দিতে। যাতে ঘরবাড়ির ক্ষতি হলেও এরকম সময়ে আমরা বাংকারগুলোতে আশ্রয় নিতে পারি। আমাদের অন্তত পোষা পশুগুলো ছেড়ে কোথাও চলে যেতে হবে না আর শরণার্থী হয়ে থাকা লাগবে না।

এ বছরে এলওসিতে যে উত্তেজনা বিরাজ করেছে তা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। চলতি মাসের ৫ তারিখে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সুভাষ ভামরে অভিযোগ করেন, চলতি বছরের জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত পাকিস্তান ৩৫১ বার চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।

ভারতীয় কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, দু’দেশের গোলাগুলিতে ২০১৭ সালে ১২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন ও ৭৯ জন আহত হন।

তবে এখানে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নেই। গ্রামবাসীরাও ভয়ে সে হিসাব দেন না।

মার্চে একবার গোলা নিক্ষেপ কিছুটা কমলে নিজের ঘরে ফেরেন ৪০ বছর বয়সী শিলিকোটের বিলাল আহমাদ। ফিরে তিনি দেখেন তার গরু ও বাছুরটা নিথর দেহে পড়ে রয়েছে। গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে পড়ে থাকা অবুঝ প্রাণীগুলোর মুখটা একটা দেয়ালের দিকে, যে দেয়ালও ঝাঝড়া।

বিলাল বলেন, গুলিতে যদি গরুটার মৃত্যু না হতো, অন্য কিছু না কিছুতে হতো।

তিনি আরও বলেন, ‘পোষা প্রাণীগুলোর মৃত্যু শুধু গোলাগুলিতেই হয় না, আমরা যখন পালিয়ে যায় তখন তাদের দেখাশোনার কেউ থাকে না। ক্ষুধায়, ঠান্ডাতেও তাদের মৃত্যু হয়। আর যদি মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় তাহলে ধারাল কোনো বেড়ায় বেঁধে গিয়ে রক্তপাতে তাদের মৃত্যু হয়।’

চলতি বছর সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে জম্মু ও কাশ্মিরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তরে উরি শহরে একটি ক্যাম্প তৈরি করে সরকার। ঘরবাড়ি ফেলে সেখানেই আশ্রয় নেয় গ্রামবাসী।

সরকারি একটি স্কুলে হাজারো গ্রামবাসীকে আশ্রয় নিতে হয় । সেখানে তারা সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালিয়ে যান স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের। স্কুলভবনে আশ্রয় নেয়া এই মানুষগুলো কোনোভাবেই জানতে পারছিলেন না তাদের স্বজনরা বাড়িতেই থেকে গেছেন না পালাতে পারলেন না বাঁচতেই পারলেন না।

যারা পালাননি তাদের একজন ছিলেন মুক্তার। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গোলাগুলির ভয়াবহতা দেখেছেন তিনি। মুক্তার বলছেন, প্রতিটা গুলির পর মতো হতো যেন একেকটা বজ্রপাত হলো। গোলাগুলো বিস্ফোরণের পর ভূমিকম্পের পর পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠত।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে গ্রামে কেবল মুক্তার একাই ছিলেন। আর একা থেকেই বেশ কয়েকটা এমন ভূমিকম্প দেখেছেন মুক্তার।

এলওসির কাছাকাছি বাংকার আর মাটির ঘরগুলোতেই জীবন শুধু বিপজ্জনক নয়, যেসব গ্রামের উপর দিয়ে সীমান্ত গেছে বা এলওসির কাছাকাছি যেসব গ্রামের অবস্থান সে গ্রামগুলোর প্রতিটি কোনায় রয়েছে বিপদ। গোয়াল ঘর থেকে শুরু করে মাঠ হয়ে বিদ্যালয়গুলোতে পর্যন্ত এ বিপদের বিস্তার।

একটা পা এদিক-সেদিক হলেই পড়ে যেতে হবে- এমন পর্বত, নদী পেরিয়ে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে এসব এলাকার শিশুদের সরকারি কোনো স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। সাম্প্রতিক এই উত্তেজনার শুরুর দিকে বাবা-মায়ের তাদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন না, তবে দিন যত যেতে থাকে স্কুলে বাচ্চাদের সংখ্যাও তত কমতে থাকে।

শিলিকোটের বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ এই অভিজ্ঞতার কথা বলেন এভাবে- বেঁচে থাকাটাই এখানে সবচেয়ে বড় কথা। লেখাপড়া, চাকরি সবকিছু তারপর। আর হাবিবুল্লাহর কথাটি তার গ্রামে সত্যই আসলে। ১৩ বছর বয়সী আমব্রিনের অভিজ্ঞতার কথা জানলেই তা বোঝা যায়। ঘটনাটা কবেকার নিশ্চিত করে সেটা বলতে পারে না আমব্রিন। তবে এটুকু তার মনে আছে, সেদিন যখন গোলাগুলি শুরু হলো তখন সে ক্লাসরুমে ছিল। ওইদিনের ঘটনার পর থেকে আমব্রিন আর কোনোদিন স্কুলে যায়নি।

সেদিনের কথা মনে করে আমব্রিন বলে, গোলাগুলির শব্দ শুরু হলেই আমি কান্নাকাটি শুরু করি। শিক্ষকরা আমাদের মাথা নিচু করে বসে থাকতে বললেও সবাই পালিয়ে যায়।

এখন উত্তেজনা একটু কম থাকলেও বাবা-মায়েদের মধ্যে আতঙ্ক আছে কখন আবার কী শুরু হয়। একই ভয় রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝেও। তাদের ভয়- আবার হয়তো গোলাগুলি শুরু হবে, আবার হয়তো তাদের পালাতে হবে।

গ্রামবাসীরা তাদের ঘরে ফিরে দেখেন প্রায় প্রতিটি দেয়ালেই গুলির চিহ্ন। কাশ্মির আর অন্য সব কিছুকে দু’টুকরো করা ভয়ঙ্কর এক সীমারেখার সামনে গুলির ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই দেয়ালগুলোই তাদের নতুন জীবনের অনুপ্রেরণা দেয়।

দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত ‘দ্য হিউম্যান কস্ট অব ইন্ডিয়া-পাকিস্তান কনফ্লিক্ট’ থেকে অনুবাদ নাঈম ফেরদৌস রিতম।

এনএফ/পিআর