জাতীয়

আত্মা নাকি পাখি হয়ে গেছে

‘আব্বু নাকি ব্রেনে আঘাত পেয়েছিলেন। যে আঘাত সারাতে পারেননি দেশের ডাক্তার, সিঙ্গাপুরের ডাক্তারও। প্রথমে কিছু বুঝিনি। পরে শুনে শুনে এতটুকু বুঝেছি, ব্রেনে কষ্ট হলে বুঝি মানুষ মারা যায়। যে কারণে বাবাও মারা গেছেন। আমি বড় হতে চাই। অনেক বড়। বড় হয়ে ব্রেনের ডাক্তার (নিউরোলজিস্ট) হব। ব্রেনের কষ্ট কমাব। বাবার মতো আর কেউ যেন হারিয়ে না যায়।’

Advertisement

আনমনে জঙ্গি হামলায় নিহত বাবা র্যাবের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের মেয়ে জারা এসব কথা বলেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার (২৯ মার্চ) ছিল আবুল কালাম আজাদের ৪৫তম জন্মদিন। আজ (৩১ মার্চ) তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রিয় বাবার সঙ্গে সুখস্মৃতিগুলো এখন জারিফ, জারা আর জাবীরের অনুপ্রেরণা।

বাসায় যাওয়ামাত্র দরজা খুলে মা মিসেস আজাদের পাশে দাঁড়ায় ছোট্ট জাবীর। চোখ-মুখজুড়ে বাবার চেহারা স্পষ্ট। শান্তশিষ্ট জাবীর আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়, কে এই আঙ্কেল? মায়ের কাছে হাজারও প্রশ্ন। বাসায় বসে স্মৃতিচারণ করেন মিসেস আজাদ। বলেন, ‘জাবীর ওর বাবাকে (আজাদ) খুব ভালোবাসতো। বাসায় আসামাত্র কোলে উঠে পড়তো। একটুও কোল ছেড়ে নামতে চাইতো না। বাবাও ওকে খুব ভালোবাসতো। ওইটুকুই চেনাজানা, চোখের দেখা। ওর বয়স যখন আড়াই বছর তখন উনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।’

Advertisement

জারিফ ও জারা বাবার ভালোবাসা পেলেও জাবীর বাবাকে খুব বেশি বুঝতে পারেনি। ছোট্ট জাবীর জানলোই না বাবা কী জিনিস, বাবার আদর কেমন? কে জানতো ভাগ্যের এক চরম পরিণতি ঘটবে ওদের জীবনে!

বাসার নিচে নামো? খেলো কার সঙ্গে, ভাইয়া-আপুর সঙ্গে? জাবীরের অদ্ভূত উত্তরে গুমড়ে কান্না চলে আসে।

এই প্রতিবেদককে জাবীরের উত্তর, ‘নিচে নামি… না। ভ…য় পাই। তাই মুখ ঢেকে নামি। উপরেই পাখির সাথে খেলি। আত্মা (আব্বু) নাকি পাখি হয়ে গেছে।’

মা মিসেস আজাদের মুখে শোনা যায় ছোট্ট জাবীরের কথার রহস্য। তিনি বলেন, ‘ওর বাবার মৃত্যুর পর আমি নিজেই ছিলাম দিশেহারা। আজাদের মৃত্যুর পর সবাই আমাকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। না জানি আমার কিছু হয়ে যায়। ওই সময়টা অবুঝ জাবীর চোখে-মুখের ভাষায় বাবাকে খোঁজে। কিন্তু পায়নি। ও বাবাকে ডাকতো আত্মা বলে। ও যখন ডাকে তখন কোনো ভাষা পাই না। কী করে ওর আত্মাকে ফিরিয়ে দেব? ওর ভাই জারিফ শিখিয়েছে, আত্মা পাখি হয়ে উড়ে গেছে। জাবীর তাই বিশ্বাস করে, পাখির সাথে খেলতে যায়।’

Advertisement

‘বাবাকে ছাড়াই এখন ওদের বেড়ে ওঠা। কাটাতে হবে সারাটা জীবন। আমি মা হয়ে বাবার অভাবটা কখনও হয়তো পূরণ করতে পারব না। তার প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি কর্মের পরতে পরতে এখন টের পাচ্ছি।’

মিসেস আজাদ বলেন, ‘কখনও অহঙ্কার নিয়ে কথা বলতেন না। বরং অন্যের কষ্ট দেখলে খুব ব্যথিত হতেন। নিজে কষ্ট বেশি করতেন। তিনি সব সময় একটা কথা বলতেন যা আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করে। আল্লাহ আমাকে যত বড় করবে, বড় জায়গায় নিয়ে বসাবে, আমার আল্লাহর কাছে তত বেশি নত হতে হবে। মানুষের সঙ্গে অহঙ্কার দেখিয়ে লাভ নেই। যে কারণে হয়তো তিনি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। তার জানাজা, কবর জেয়ারতে দেখেছি মানুষের ঢল।’ ‘মৃত্যুকে কখনও ভয় পেতেন না। বলতেন, আমার দায়িত্ব আমাকে শেষ করতে হবে বেঁচে থাকতেই। মৃত্যু দোরগোড়ায় চলে আসলে তা কখনও ঠেকানো যায় না।’ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি জঙ্গি আস্তানায় যাবার আগে সপরিবারে ঘুরেছেন র্যাবের সাবেক এই গোয়েন্দাপ্রধান। নিউ মার্কেটে গেছেন। কেনাকাটা সেরে চলে গেছেন সিলেটে। তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন আর ফিরবেন না। তাই চলে যাবার মুহূর্তটা রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন।

বাবা আজাদ জারিফকে সব সময় বড়কিছু হবার উপদেশ দিতেন। বলতেন, অনেক বড় হতে হবে। অন্যের অটোগ্রাফ নিতে নয়, এতো বড় হতে হবে যেন অন্যরা তোমার পেছনে অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ছোটে। দেশের জন্য জারিফ বড় সাইন্টিস্ট হবে। বাবাকেও ছাড়িয়ে যাবে। এমন স্বপ্নের কথাই জানায় জারিফ।

মা মিসেস আজাদ বলেন, ‘তিনি (আজাদ) একাধারে বাবা, স্বামী, ভাই ও সন্তান হিসেবে যে অপরিসীম মমতা আর ভালোবাসায় দায়িত্বপালন করে গেছেন, তা আমার জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। তার অবর্তমানে সন্তানদের স্বপ্ন পূরণ করাই আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ।’

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকার ‘আতিয়া মহল’ জঙ্গি আস্তানায় পরিচালিত অপারেশন ‘টোয়াইলাইট’র পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যান র্যাবের গোয়েন্দাপ্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। ঘটনাস্থলের ৩০০ গজ দূরে জঙ্গিদের রেখে যাওয়া বোমা বিস্ফোরিত হলে স্প্লিন্টার বাম চোখ ভেদ করে তার মস্তিষ্কে আঘাত হানে।

তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে জরুরি ভিত্তিতে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। পরের দিন ২৬ মার্চ উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা শেষে গত ২৯ মার্চ দেশে ফেরত এনে পুনরায় সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩১ মার্চ রাত ১২টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ১৯৭৫ সালের ৩০ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের ৭ জুন ৩৪তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদী কোর্সে ইস্ট বেঙ্গেল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাসদর, প্রশাসনিক শাখা, জাতিসংঘ মিশন ব্যানব্যাট- ৫ (আইভরিকোস্ট), ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন, ১৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন), র্যাব- ১২ এর কোম্পানি অধিনায়ক ও র্যাব সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের (টিএফআই সেল) উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর হতে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।

জেইউ/এমএআর/পিআর