মতামত

শাহাদুজ্জামানের ‘একজন কমলালেবু’

কবিতায় উড়ে গেছে ঘরকবিতায় হয়নি বাসরকবিতায় সব নারী পরকবিতায় জোটেনি কাপড় ।

Advertisement

আপাত একটি ব্যাকরণগত ভুল দিয়ে শুরু, একজন কমলালেবু। শাহাদুজ্জামান কথা জানেন , বলেন। শুনি , শুনতে ভালো লাগে। লিখে কথা বলা এবং তা শোনানো , অসম্ভব কঠিন। তিনি পারেন , পেরেছেন। কবিতার ঘরে হেঁটেছেন , কখনও অবশ্য দৌড়াতেও চেষ্টা করেছেন। নিমগ্ন ছিলাম।রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, বগুড়া রোডে। হঠাৎ আসামে গিয়েছি। তথ্য পেয়েছি অর্ধশতাধিক বই পুস্তক এর মূল্যবান মাল্যবান সম্পর্কে। ঝকঝকে ছাপা আর সমীকরণ মিলানো শব্দবিন্যাসে চোখ রেখে বইটির দারুণ বাঁধাই ধরে ভেবেছি , কত কথা জানি না !

জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। জীবনানন্দ। কমে বেড়ে ভুলে মাশুলে মাটিতে পা রেখেই আকাশ চিনেছেন। তিরস্কার,বঞ্চনা , উপেক্ষা আর অপেক্ষা তার নিয়তি। একজন শিক্ষিত বোহেমিয়ান ,একজন উঁচুদরের কল্পনাবিলাসী প্রেমিক- কবি জীবনানন্দ দাশ।

গণিকালয় থেকে শোভনার দূরত্ব যত, কবির নিন্মকন্ঠ প্রেমের গুরুত্ব তার চেয়ে অধিক বৈ কম নয়। জৈবিক মাস্টারবেশন থেকে নির্জীব লাবণ্যে তিনি চুপচাপ সরব । বেকারত্বেও ছায়া গল্পে, উপন্যাসে। কবিতা তো তার বৈশ্বিক প্রেম , শুদ্ধতার আবরণে প্রকৃতির মোড়ক । জনজীবনের সাথে নিজের বিচ্ছিন্নতার ভার তিনি নিজেই ক্রমশ বাড়িয়ে তুলেছেন। পর্দা তুলে দিয়ে পৃথিবী দেখার এ দুর্বোধ্য স্বভাব তাকে নিস্তরঙ্গ করেছে। শিক্ষকতার মত চাকরিও তার অসহ্য ঠেকেছে । আবার জীবনের তাড়নায় চাকরি খুঁজে পাওয়ার বাসনাও লেপ্টে আছে পায়ে পায়ে। কখনও নিজেই ছেড়েছেন , কখনও ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

Advertisement

একা একটি কক্ষ , নির্জন ।ঘরের মধ্যে ঘর, তার সবসময়ের চাওয়া।নিঃসঙ্গ এক অভিমানী অভিযাত্রায় যৌবনের প্রেম , বিয়ে এবং সংসার কিছুই তার সফলতার চিহ্ন বহন করে না। লোকজন চেনে না। সংকীর্ণ একঘেয়ে হতাশ জীবনের স্রোতে তিনি যদিও এক কাব্যিক মহা সমুদ্র। দ্বিতীয় জীবন বেছে নিয়েছেন। লিখেছেন। স্রোতে কখনও কখনও হারিয়েও গেছে। রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরী ধূর্জটিপ্রসাদকে তিনি ইশারা দিয়েছিলেন , তাঁরা সে অর্থে সাড়া দেননি।

ট্রাংকের নিচে কত শত কবিতা , কত গল্প , উপন্যাস । সব ছাপেন নি । ছাপাতে পারেন নি । থেমে যান নি । নিজেই ছেপেছেন কিছু। মাঠে নতুন ফসলের গন্ধ , মহাজনদের ভালো লাগেনি । চাপিয়ে রেখেছেন । কিন্তু তিনি তো জীবনানন্দ । ছাই চাপা আগুন । যখনই প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতা,কেউ কেউ ঠাট্টা করেছেন । কেউ পক্ষেও দাঁড়িয়েছেন । বুদ্ধদেব বসু । অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত । সবচেয়ে বড় বিষয় জীবনানন্দ নিজেই নিজের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন । দাঁড়ানোর শক্তিটা তার ছিল । গদ্যে প্রবন্ধে যুক্তিপূর্ণ জবাব বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে নিজের কবিতার শক্ত ভিত তৈরি করার যে সাহস , সেটা অনির্বচনীয় । কারণ ভাবাবেগের অভিযোগে হতাশ অশান্তি ইত্যাদি অভিধায় আক্রান্ত কবি , টলস্টয় গেটে কীটস শেলী এদের কথাই ভাবতেন।

ভাবনার অসীম দূরত্ব তাকে সব সংঘ থেকে দূরে রেখেছে, নিজেই খাড়া হয়েছেন ভবিষ্যতের মহীরূহ হয়ে। কবিতার নদীতে একচ্ছত্র সমসাময়িক কবিদের ভীড়ে হারিয়ে গিয়েও তলে তলে শিল্পের পলি জমিয়েছেন, নদী তার বাঁক বদলেছে। বলা যায় , বদলাতে বাধ্য হয়েছে। ভাষায় তিনি হেঁটে হেঁটে সময় অতিক্রম করেছেন, টের পায়নি কেউ। কবিতার ভূগোলই গেছে পাল্টে।

অনেক পরে পুরস্কার পেয়েছেন , আমলে আনেন নি। পুত্র-কন্যাসহ আত্মহননের কথাও ভেবেছেন । শসা, পেঁচা যার কবিতায় আসে , তার কাছে শীত বসন্ত সব আসে। গল্পে গল্পে নিজের দ্বিধা প্রকাশ করেছেন , উপন্যাসে দার্শনিক প্রশ্নের অবতারণা করেছেন । প্রকৃতিকে তোষণ করেছেন , করেছেন আত্মায় শোষণ। রবীন্দ্র-নজরুল বলয় ভেঙ্গে দিগন্তজোড়া ব্যাপ্তিতে কবিতাকে করেছেন শাসন।কখনও মৃত্যুর বন্দনা করে করে এগিয়েছেন , মরণকে চেয়ে নিয়েছেন ।কবিতার রাজ্যে যা বিরল কিন্তু আগ্রহ উদ্দীপক।অমীমাংসায় ভরা তার জীবন । অভাব তার নিত্য সঙ্গী । কবিতা তার আজন্ম উত্তরাধিকার , যদিও মা কুসুমকুমারীর আদর্শিক ধারা তার সব সময়ের বিচরণভূমি নয় । প্রেম তার আরাধ্য , বিয়ে অসুখ । বনলতা সেন যদি সত্যিই নাটোরের কোনও গণিকার নাম হয় , বিস্মিত হওয়ার আর বাকি থাকে না। বনলতা যদি বন ও লতা হয়, প্রকৃতির কবি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ! জিজ্ঞাসা শেষ হয় না,অধরাই থাকে।

Advertisement

সুধীন্দ্রনাথ বা বিষ্ণুদের সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনও ভাবাদর্শ তাঁকে ছোঁয় না। মনন তাকে ছোঁয় , মানুষকে সে । যদিও প্রেমিকার বুকে রোপন করেন তিনি সমাজতন্ত্র। ঘাস , সমান ও বহুরৈখিক । কাঁথার বুনন যেমন শেষ হয় , হয় না । তার অসীম জিজ্ঞাসা ও আদর্শের বিস্তার কখনও মন শান্ত করে ,করে না।

এই যে তার অগণতান্ত্রিক যাপন , এটা দীর্ঘদিন কবিতা পড়ে বুঝিনি । স্বরাজে চাকরি করেও কবি টেকেন নি । লেখার রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্রাট, সামান্য প্রজা হয়ে বাঁচবেন, কী করে সম্ভব? বিশ্বযুদ্ধ তাকে শংকিত করেছে , তিনি ক্লান্ত বোধ করেছেন। অভাব তাকে উদভ্রান্ত করেছে,মানুষের ধন আহরণের প্রক্রিয়ায় তিনি বিরক্ত হয়েছেন। চাকরির জন্য ছুটেছেন। শরীর ছুটলেও মন ছোটেনি। উপমায় উপমায় শব্দ বন্দী করেছেন,নিজেকেও। একঘেয়েমিপনায় লেখালেখিকেই পথ জেনেছেন, বহুমাত্রিক পথের সাহসী পথিক হয়েছেন!

শোভনাকে চুমু খেয়েছেন, সবটুকু পারেন নি। শোভনাও নয়। কবির প্রথম উৎসর্গ বা অসংখ্য চিঠি প্রেমিকা মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, জানানোর মত পথ রহস্যময়ী রুপ আবরণী শোভনা, নিজেই রুদ্ধ করেছেন। জীবনানন্দের প্রেম নিয়ে তার নিষ্ঠুর নিরুদ্বিগ্নতা আমাদের বুকে মোচড় দেয়, কবিকে করে আশাহত এবং অশান্ত। বলাই বাহূল্য শোভনা কত কবিতার উৎস! আহা জীবনানন্দ!

লাবণ্যকে নিয়েছেন, পান নি। বরিশালকে ভালোবেসেছেন, থাকেন নি। শেষে দেশ ভাগের মহামারিতে কলকাতা থেকে বরিশালে আসার ভিসাও জোটেনি। মৃত্যু চেয়েছেন তিনি, নিশ্চুপ। পেয়েছেন। গোয়েন্দারা ক্লু পেয়েছেন, লেখকগণ হিসেব মিলিয়েছেন। এক সত্য অন্য সত্যের ওপর ভর করেছে। সাহিত্যাকাশের এক দুর্ঘটনা আরও বড় রহস্য উপন্যাসের আঁকড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শক্তিশালী পাঠক প্রভাকর,গুণমুগ্ধ ছাত্র শামসুদ্দিন আবুল কালাম বা বন্ধু সঞ্জয়, ভূ’মেন্দ্র অচিন্ত্য তাঁর হাসি দেখেছেন ।বেতফলের মত চোখ নিয়ে আমি কিছুই দেখিনি।

দুর্ভাগ্য মানতে হয় বৈকি। বিবেকও তো ঈশ্বর। বোধ, ভগবান। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে থাকা সৃষ্টিতেই স্রষ্টা। যে কথা বলতে পারলাম না সেটাই পাঠক হিসেবে আমার সীমাবদ্ধতা।

কবির সাথে বুদ্ধদেব বসুর দূরত্ব বা সজনীকান্তের কাঁটাছেড়া, সম্পর্কের ভাঙ্গাসেতু। পাগলের প্রগভলতায় তিনি এক সক্রিয় সভ্যতা যা সব যুগকে ছুঁয়ে যায়। মাতলামির মাতমে তিনি এক সুররিয়ালিস্ট শিল্পী যিনি গলেছেন, টলেন নি। পাঠক বনলতাকে যতটা চিনতে চেয়েছে বা চেষ্টা করেছে– জীবনানন্দের প্রেমে ততোধিক পড়েছেন। তাই জীবনানন্দের চেয়ে বনলতা সেন জনপ্রিয়, শাহাদুজ্জামান ঠিক বলেন নি।

বরং জীবনানন্দের জীবনের সাথে সকল লেখার মিল ধরতে চেয়ে ধারা বর্ণনাকারি সংবেদনশীল থাকার সযত্ন সতর্ক থাকায় পাঠক কমবেশি ব্যথিত হয়েছেন। যারা লিখবেন তারা না খেয়ে থাকবার যন্ত্রণা পোহানোর কথা ভেবে কল্পনা শক্তি নষ্ট করবেন অথবা নিশ্চিত কর্মসংস্থান বিষয়ে ভাবতে ভাবতে নিজেদের বিষয়েই অধিক মনোযোগী হবেন, আমার অনুমান।

এটা ঔপন্যাসিকের দুর্বলতা মোটেও নয় বরং সময়,অবস্থান , চরিত্রকে আত্মস্থ করে পাঠকের মনে গেঁথে দেয়ার শক্তিশালী মানস, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও পথকে চোরাগুপ্তা হামলা থেকে রক্ষা করার এক মহৎ বর্ম, প্রতিটি বাঙ্গালীর এ পথ চেনা জরুরি। সহজ শব্দ ও বোধগম্য ভাষা গল্পকারের আয়ত্ব। গল্প বলার ঢং নিজস্ব এবং গতিময়। যদিও গতিময়তার দ্রুতি ও বেগ নিয়ে কাঁচা রাস্তার ধুলোমাটিতে হাঁটতে পারলে আরও ভালো হত। হয়ত কলকাতার কংক্রীট, ট্রাম ও যান্ত্রিকতা বিষয়ে একাধারে পড়াশুনা করতে করতে তিনি গায়ে সে অর্থে ধুলা লাগান নি। তাই বর্ষার প্রথম বৃষ্টির মত গাঁয়ের কাঁচা রাস্তায় ধুলার সোদা গন্ধের বদলে তার বর্ণনাক্রম পরীক্ষার খাতায় প্রথম হওয়া ছেলেটির মত পরিপাটি ও শুদ্ধ হয়েছে, মাথা ভরেছে এবং দিল মরেছে।

পক্ষপাতহীন হয়ে তিনিও শোভনার মত নিস্ক্রিয়ই থেকেছেন, যদিও নিষ্প্রভ থাকেননি। পাঠক হেঁটেছেন বেশি। পাঠক ক্লান্ত যদি কখনও হন, হয়েছেন। শূন্যতার সোনালী বিভায় ঝরা পালক নিয়ে জীবন উপলব্ধি করার প্রেরণায় আবারও যদি পাঠক হাঁটা শুরু করেন, শাহাদুজ্জামানের কৃতিত্ব তাতে কম নয়।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘রূপসী বাংলা’ রাখেন নি, রেখেছেন অন্য কেউ। অজানা তথ্যের এরকম বিন্যাস ও সমাবেশ ঘটিয়ে কথা সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ধারালো কলম ধানসিঁড়ির স্রোতে প্রথমা’য় প্রবাহিত হয়েছে বলে, তাঁকে ভালোবাসা। ‘সাতটি তারার তিমির’ হতে পারলে ‘একজন কমলালেবু’ হতে দোষ কী! নামটি মনে ধরেছে। পারসনিফিকেশন, নিশ্চয়ই ‘করাপশন’ নয়! নোটেশন তো ছিলোই হা হা হা।

লেখক : কবি।

এইচআর/পিআর