মিসেস আজাদ
Advertisement
একটি পরিবারের জন্য ভালোবাসা, মমতা, দায়িত্বানুভূতি যে কী অপরিসীম প্রয়োজন তা টের পেয়েছি তার চলে যাওয়ায়। আমাকে যেন মাঝ দরিয়ায় রেখে গেছেন তিনি। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নিজের সফলতার সাক্ষর রেখে গেছেন। পরিবারের জন্য, নিজ কর্মক্ষেত্রে অনেক কষ্ট করেছেন। গোপনে কষ্ট করেছেন কিন্তু কখনোই দায়িত্ব ভুলে যাননি। তার ভালোবাসা আর আদর্শই এখন আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
প্রত্যেকটা স্মৃতি আমাকে কাঁদায়। আমাকে ভাবায়। আমাকে বাঁচার জন্য অনুপ্রাণিত করে। মানুষের কষ্টে যিনি খুব মর্মাহত হতেন তিনি নেই। তাকে হারিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ফের ভেবেছি দায়িত্ববান মানুষটির সহধর্মিণী হিসেবে আমার অনেক দায়িত্ব। বসে থাকলে চলবে না। নিজেকে সামলে নিয়ে চলেছি।
মায়ের সঙ্গে লে. কর্নেল আজাদ
Advertisement
আজ লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের ৪৬তম জন্মদিন। যে মানুষটি দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে চিরতরে ইহজগত ছেড়ে চলে গেছেন তাকে অনুভব করছি সারাক্ষণ। এ দিনটি ছিল আমাদের একান্ত নিজেদের। তারই জন্মদিন তাকে ছাড়া। তার ভালোবাসা, মমতা সব অনুভব করছি।
ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সাদামাটা, সহজ-সরল ধরনের ছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক প্রধান লে. কর্নেল আজাদ। তাকে আমি একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবে জানি। তিনি রোল মডেলও বটে। খুবই অবাক হয়ে ভাবতাম যে, একজন মানুষ এতোটা ভালো, এতোটা উদার, এতোটা সৎ কী করে হতে পারে! বিবাহিত জীবনের ১৭ বছর স্বামী হিসেবে ছিলেন আদর্শ। তিন সন্তানের পিতা হিসেবে ছিলেন আদর্শ। কর্মস্থলেও ছিলেন সবার আদর্শ।
তিনি সমানতালে পরিবার ও কর্মস্থল সামলেছেন। কোথাও বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। অনেক কষ্ট হতো বুঝতাম। কিন্তু কোনো দায়িত্বকেই তিনি ফাঁকি দিতেন না। কোনো দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি। সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করতেন। ব্যস্ততার মাঝে বন্ধুদের সময় দিতেন। পরিবারের ছেলে হিসেবে তিনি বাবা-মার প্রতি, ভাই হিসেবে ভাই-বোনদের প্রতি, স্বামী হিসেবে এবং সন্তানের বাবা হিসেবে সফল ছিলেন।
স্বামী নয়, আমার বন্ধু ছিলেন আজাদ। কিন্তু তার মতো সত্যিকারের বন্ধুকে অবেলায় কখনও হারাব বুঝিনি। তাকে হারালে আমার কী ক্ষতি হবে ভাবিনি। এখন হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছি। সব কাজ নিজ দায়িত্বে করে নিতেন বলে আমার কিছুই করতে হয়নি। বাইরের কোনো কাজ আমার জন্য রাখতেন না। আজ তিনি নেই। সব এসে চেপে বসেছে আমার ওপর। ঠেকছি, শিখছি। তার কথা ভেবে ভেবে চলছি।
Advertisement
প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছি, নিজের সঙ্গে, মনের সঙ্গে। একটি বছরে টের পেয়েছি কী এক মানুষকে হারিয়েছি আমি। কিছুই ভালো লাগে না। তবুও সন্তানদের জন্য ভালো থাকার অভিনয় করে চলেছি। বেঁচে আছি কিন্তু সুখ নেই, মনে শান্তি নেই। ভালোবাসার মানুষটি নেই। যিনি যাচিত-অযাচিতভাবে সবকিছু দিয়ে দিতেন উজাড় করে তাকে ছাড়া ভালো থাকা যায়?
একটি ঝড় নিমিষেই স্বপ্নকে তছনছ করে দিতে পারে, ভাবিনি। কী থেকে কী হলো। চোখের সামনে সুখ, ভালোবাসায় টইটুম্বুর গোছানো সংসার আমার তছনছ হয়ে গেলো। মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন সুখের ঘরে কারো নজর লেগেছিল কিনা!
আজাদ ছিলেন সন্তানদের কাছে প্রিয় একজন মানুষ। সময় পেলেই সন্তানদের বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন। ঘুরতে নিয়ে যেতেন। পড়াতেন নিজেই। খেলতেনও। আমার বড় দুই ছেলে-মেয়ে ওকে ভীষণ মিস করে। আমার তিন সন্তানের ছোট্ট মনজুড়ে ওর বাবার স্মৃতি। একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে গেছে সেই ঝড়।
তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশ ঘুরেছেন সপরিবারে। সেসব স্মৃতিই এখন আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। কিন্তু সন্তানদের অবুঝ মন তো মানে না। ওরা ওইসব স্মৃতি হাতড়ে গোপনে কাঁদে। আমিও কাঁদি গোপনে। সবাই জানি কাঁদছি। কিন্তু না জানানোর চেষ্টায় লুকিয়ে কাঁদি।
লে. কর্নেল আজাদের সঙ্গে ২০০০ সালের ৩০ ডিসেম্বর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হবার পর অনেক স্থান ঘুরেছি ওর চাকরির সুবাদে। বিয়ের পর ওর পোস্টিং ছিল সিক্স বেঙ্গল ময়মনসিংহে। এরপর ২০০১ সালের ডিসেম্বরে পোস্টিং হয় আর্মি সদর দফতরের প্রশাসনিক শাখার অ্যাডজুডেন্ট হিসেবে। ২০০৪ সালে আমাদের ঘর আলো করে আসে প্রথম সন্তান জারিফ। ২০০৫ সালে মিশনে যান আজাদ। পরের বছর মিশন শেষ করে এসেই সুযোগ মেলে কমান্ডো ব্যাটালিয়নে। সিলেট পোস্টিং। ২০০৯ সালে ১৯ বেঙ্গল সাভারে থাকতে জন্ম হয় মেয়ে জারার। দুই সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন বড় হতে থাকে। আড়াই বছর পর র্যাব-১২ তে পোস্টিং। তিন মাস পর তিনি ফের পোস্টিং নিয়ে আসেন র্যাব সদর দফতরে। ২০১৩ সালে নতুন র্যাংক পরেন। লে. কর্নেল হিসেবে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
২০১৪ সালে জাবীরের জন্ম। দুই বছর তিন মাস বয়স যখন জাবীরের তখন সব ছেড়ে আজাদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। জারিফ, জারা বাবার আদর পেলেও জাবীর বাবার আদর বুঝলোই না। ছোট্ট জাবীর জানলোই না বাবা কি জিনিস, বাবার আদর কেমন। অথচ এই ছোট্ট জাবীর বাবাকে চিনতো। বাবা অফিস শেষ করে ফিরলেই কোলে উঠে পড়তো। প্রিয় বাবাকে যেন কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইতো না জাবীর। কে জানে যে, ভাগ্যের ওই চরম পরিণতি ঘটবে ওদের জীবনে।
বাবাকে ছাড়াই এখন ওদের বেড়ে ওঠা। কাটাতে হবে সারাটা জীবন। আমি মা হয়ে বাবার অভাবটা কখনও হয়তো পূরণ করতে পারব না। আমিও যে দিশেহারা! তার প্রত্যেকটা স্মৃতি, প্রত্যেকটা কর্মের পরতে পরতে টের পাচ্ছি।
সবচেয়ে কষ্টের হচ্ছে, উনি (আজাদ) একাধারে বাবা, স্বামী, ভাই ও সন্তান হিসেবে যে অপরিসীম মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছেন, তা আমার জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের।
সবার কাছে দোয়া চাই, আজাদ যে রকম আইডল ছিলেন, আদর্শবান ছিলেন, তার সন্তানদের যেন আরও বেশি উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারি। আজাদ চাইতেন তার সন্তানরা তার বাবাকে ছাড়িয়ে যাবে। একেকজন একেক সেক্টরে আদর্শ হবে। ওদের বাবার স্বপ্ন পূরণই আমার এখন প্রধান দায়িত্ব। আমাদের জন্য সবার দোয়া চাই। আজাদের জান্নাত কামনায় দোয়া চাই। ওপারে ভালো থাকুন আজাদ। ওপারে গিয়ে ফের যেন মিলিত হতে পারি মমতায়-ভালোবাসায়। জন্মদিনে শুভেচ্ছা মিস্টার আজাদ।
জেইউ/এমএআর/আরআইপি