খেলাধুলা

বিশ্বকাপের পাঁচ পরিষ্কার ফেবারিট

তিন মাসও বাকি নেই আর রাশিয়া বিশ্বকাপের কিক অফের বাঁশি বাজার। এখন থেকেই ফুটবলপ্রেমীদের স্নায়ুর উত্তেজনা বেড়ে চলছে। বেড়ে উঠছে পালস রেটও। এমনকি এখনই ফুটবল বোদ্ধারা শুরু করেছেন, বিশ্বকাপ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার। বড় বড় দলগুলোর বেশ কিছু তারকা ফুটবলারের ইনজুরিতে পড়ে বিশ্বকাপে খেলাটা হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। যত যাই হোক, ইএসপিএন সকারের বিখ্যাত ফুটবল লিখিয়ে ইয়ান ডার্ক ৫টি দলকে বাছাই করে নিয়েছেন, যারা রাশিয়া থেকে বিশ্বকাপ জয় করে ঘরে ফিরতে পারে।

Advertisement

ইয়ান ডার্ক শুরুতেই পাঁচটি দলের নাম প্রকাশ করে নিজের নিবন্ধটার প্রতি পাঠকের আগ্রহকে নষ্ট করে দেননি। শুরু করেছেন ধারাবাহিক আলোচনা। শীর্ষ থেকে শুরু করে পাঁচ নম্বর পর্যন্ত প্রতিটি দলের বিশ্লেষণ উঠে এসেছে তার এই লেখায়। তিনি দেখিয়েছেন, কী কী কারণে তার নির্দিষ্ট সেই পাঁচটি দল বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম দাবিদার।

বিশ্বকাপে ফেবারিটের তালিকা করলে শুরুতেই নাম আসে বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানির। যে দলটি তারকা ফুটবলারে ভর্তি। সঙ্গে রয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা কোচ জোয়াকিম লো। যিনি একাই অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে নিজের দলকে অনেক দুরে নিয়ে এসেছেন। যদিও জার্মানদের আত্মম্ভরিতা এবং অতি আত্মবিশ্বাস হতে পারে তাদের প্রধান শত্রু। এ কারণেই সম্ভবত টিম বাসের স্লোগান, ‘বেস্ট নেভার রেস্ট’ তাদের পরিচয় বহন করে।

গত বছর রাশিয়া থেকে ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জয় করেছে বলতে গেলে পুরোপুরি রিজার্ভ বেঞ্চ নিয়ে। তবে শঙ্কিত হওয়ার কারণও আছে জার্মানিকে নিয়ে। পরিসংখ্যানবিদরা হয়তো ঘেঁটে-ঘুঁটে বের করে বলবেন, যে দল ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জেতে, তারা তো পরের বছর বিশ্বকাপ ট্রফিটা জিততে পারে না!

Advertisement

জার্মানদের আরও একটা সমস্যা আছে। সেটা হলো- গোল করবেন কে? দলটিতে মিরোস্লাভ ক্লোসা নেই। ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের মতো খাঁটি কোনো স্ট্রাইকারও নেই। এক মারিও গোমেজ রয়েছেন, যিনি এখন বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে পড়েছেন। তার পরিবর্তে টিমো ওয়ার্নার, সান্দ্রো ওয়াগনার এই জায়গাটা নেয়ার চেষ্টা করছেন। তবুও স্পেনের সঙ্গে ১-১ ড্র এবং ব্রাজিলের কাছে ১-০ গোলে হার- বিশ্বকাপের আগে জার্মানিকে নিয়ে ভক্তদের কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তুলছে। তবুও, ফেবারিটের তালিকায় এখনও ব্রাজিলের ওপরে রয়েছে জার্মানি।

৫ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের সাম্প্রতিক উত্থানটা বলতে গেলে স্বপ্নের মতো। লাতিন আমেরিকান বাছাই পর্বে তো কঠিন বিপদেই পড়ে গিয়েছিল ব্রাজিলিয়ানরা। ২০১৪ বিশ্বকাপের বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিল না সেলেসাওরা। কার্লোস দুঙ্গার অধীনে ব্রাজিল যেন দিনের পর দিন গভীর অন্ধকারেই নিমজ্জিত হচ্ছিল। এই অবস্থায় একেবারে খাদের কিনারায় থাকা দলটির দায়িত্ব নিলেন তিতে।

তিতের রয়েছে সাম্বা ফুটবল নিয়ে রোমান্টিক ভিশন। যে কারণে তিনি দলটিতে মিশ্রন ঘটিয়েছেন নানা উপাদানের। জার্মানির কাছে ৭-১ গোলের হারের আবেগকে তিনি পুরোপুরি সরিয়ে দিলেন দলের খেলোয়াড়দের মানসিকতা থেকে। সমর্থকদের ইচ্ছার পরিস্ফুটন ঘটাতে তিনি দলটিকে গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে। যে রূপটি সব সময়ই ব্রাজিল ফুটবলকে ঘিরে থাকে। ‘জোগো বোনিতো’কে বিসর্জন না দিয়ে আধুনিক ফুটবলের সংমিশ্রন ঘটালেন দলের মধ্যে। সুতরাং, তিতের ব্রাজিল হয়ে উঠেছে বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ফেবারিট।

তবে, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- সময়ের সঙ্গে দৌড়ে বিশ্বকাপের আগে নেইমার কি সম্পূর্ণ ফিট হয়ে উঠতে পারবেন? ডান পায়ের ফিফথ মেটাটারসালে যে ভাঙন ধরেছে এবং সেখানে যে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন তিনি, তা থেকে সময়মতো মুক্তি মিলবে কি ব্রাজিল সুপারস্টারের?

Advertisement

নেইমার যদি সত্যি সত্যি ফিট হয়ে ওঠেন, তাহলে ব্রাজিল দলে সিল্কের যে সংমিশ্রন (উইলিয়ান, কৌতিনহো, জেসুস, নেইমার) এবং স্টিলের যে সংমিশ্রন (কাসেমিরো, ফার্নান্দিনহো, মার্কুইনহোস, মিরান্দা)- তা হবে সত্যি ভয়ঙ্কর এবং অনেক বেশি শক্তিশালী। সঙ্গে যোগ করে নিতে পারেন দুই সেরা গোলরক্ষক অ্যালিসন এবং এডারসনকে। এছাড়া রয়েছেন উড়ন্ত দুই ফুলব্যাক দানি আলভেজ এবং মার্সেলো। আপনি চাইলে এই ব্রাজিল দলকে ১৯৫৮ সালের সঙ্গেও তুলনা করতে পারেন, যারা প্রথম ইউরোপের মাটি থেকে বিশ্বকাপ জয় করে নিয়ে গিয়েছিল।

বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিটের তালিকায় স্পেনের নাম না এনে কোনো উপায় নেই। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে যে স্পেনকে দেখা গেছে, রাশিয়া বিশ্বকাপে তারা কতটা দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে সেটাই এখন দেখার বিষয়। আগামীকাল কিংবা পরবর্তী সময়েও এই স্পেনকে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সার্জিও রামোসের নেতৃত্বাধীন দলটিতে অসাধারণ অভিজ্ঞতা এবং টেকনিক্যাল উৎকর্ষতার মিশেল ঘটেছে খুব নিখুঁতভাবে। যেটা ইতালি দেখতে পেয়েছে বাছাই পর্বে। প্রতিপক্ষ এক কোচের ভাষ্যে, ‘স্পেন দলটির ফুটবলাররা এক টাচে যেভাবে বল নিয়ে চোটেন, যেন সেটা দানবীয় কিছু।’

দলটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন! ডেভিড ডি গিয়া, সার্জিও বুস্কেটস, ডেভিড সিলভা, ইসকো, সার্জিও রামোস, জেরার্ড পিকে, জর্দি আলবা, থিয়াগো আলকানতারা, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা এবং দিয়েগো কস্তা। লিওনেল মেসি এই দলটির দিকে তাকিয়ে বলেছেন, ‘আপনি কদাচিৎ এই দলটির মুখোমুখি হতে চাইবেন।’

স্পেনের পর ফ্রান্সই হতে পারে এই বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট। কোচ দিদিয়ের দেশম ১৯৯৮ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। তার অধীনে দলটি এখন অনেকটাই সংগঠিত। সেরা তারকা নিঃসন্দেহে আন্তোনিও গ্রিজম্যান। ২০১৬ ইউরোয় সর্বোচ্চ (৬টি) গোলদাতা তিনি। এখনও যে ফর্মে রয়েছেন, নিশ্চিত রাশিয়ায়ও একই ফর্ম দেখাতে পারেন তিনি।

এরপর রয়েছে দলটির অন্যতম সেরা এবং মেধাবি তরুণ ফুটবলার কাইলিয়ান এমবাপে। মিডফিল্ডে এনগোলা কান্তের দারুণ পরিশ্রম এবং সেন্টার ব্যাকে রাফায়েল ভারানে ও স্যামুয়েল উমতিতি দলটির শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ম্যানইউতে সমস্যায় থাকলেও নিজের দেশের হয়ে দারুণ খেলবেন পল পগবা। নিজেকে উজাড় করে দেবেন তিনি- এটাই ফরাসিদের আস্থা। ফরাসিদের প্রধান তারকাও তিনি। পগবাই পারেন, স্টেডিয়ামে নীল জার্সির উৎসব সৃষ্টি করতে।

যদিও দলটির অন্যতম সমস্যা হচ্ছে- ধারাবাহিকতার অভাব। ২০১৬ ইউরোর ফাইনালে পর্তুগালের কাছে হারের রেশ এখনও কেটে যায়নি। এছাড়া বাছাই পর্বে বেলারুশ এবং লুক্সেমবার্গের কাছে পরাজয়ের পর সম্প্রতি প্রীতি ম্যাচে কলম্বিয়ার কাছে ২-০ গোলে হেরেছে ফ্রান্স। এরপর ফরাসিদের নিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপে ভক্ত-সমর্থকরা স্বপ্ন দেখতে সাহস পাচ্ছেন কম। তবুও দলটি অনেক বেশি মেধাবি ফুটবলারের সমন্বয়ে গড়া। এ কারণেই ফেবারিটের তালিকায় রয়েছে ফ্রান্স। কিন্তু একটি বাজে দিনই হয়তো নষ্ট করে দিতে পারে সব কিছু।

ফেবারিটের তালিকায় আর্জেন্টিনাকে না রাখলে অপরাধই হয়ে যাবে। দলটিতে বিশ্বসেরা তারকার অভাব নেই। বলা যায় তারকাভর্তি টাইটানিক। বিশ্বসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি, সার্জিও আগুয়েরো থেকে শুরু করে বিশ্বসেরা সব তারকার মিলনমেলা ঘটেছে দলটিতে। তবুও সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার পাওলো দিবালা এবং অন্যতম তারকা মাউরো ইকার্দিকে ছাড়াই সম্ভবত রাশিয়া বিশ্বকাপে দল নিয়ে যেতে হবে সাম্পাওলিকে।

এতবড় তারকাভর্তি টাইটানিক থাকা সত্ত্বেও বিশ্বকাপে খেলাটাই শঙ্কার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল আর্জেন্টাইনদের। শেষ পর্যন্ত বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে মেসির হ্যাটট্রিকে কোনমতে রাশিয়ার টিকিট কাটতে সক্ষম হয় তারা।

তবে রাশিয়ায় কোচ সাম্পাওলির একটি ট্যাকটিসই হয়তো আর্জেন্টিনার ভরাডুবির জন্য যথেষ্ট হতে পারে। তার প্রায়ই ঝোঁক হচ্ছে, ডিফেন্সের ওপর জোর দিয়ে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডকে কিছুটা ফাঁকা করে ফেলা। এই ভুল ট্যাকটিসই হয়তো নকআউট স্টেজের কোনো না কোনো পর্ব থেকে ছিটকে দিতে পারে আর্জেন্টিনাকে।

মেসিকে ছাড়াই স্পেনের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে খেলতে নামতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। এক মেসি না থাকলে দলটির যে কী চেহারা হয় তা ৬-১ গোলে পরাজয়ের পরই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিশ্চিত বুয়েন্স আয়ার্সে সতর্ক সঙ্কেত বেজে উঠেছে। নিশ্চিতভাবেই এই দলটির এখনও অনেক কাজ করার বাকি সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। সময় যতটা হাতে আছে, তাতে দৌড়ে সাম্পাওলি কতটা জিততে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।

বাকি দলগুলোর মধ্যে বেলজিয়াম অন্যতম শক্তিশালী। কেভিন ডি ব্রুইন, এডিন হ্যাজার্ডরা রয়েছেন এই দলে। আছেন মারিয়ানো ফেল্লাইনি, গোলরক্ষক কুর্তোয়া, ডিফেন্ডার ভিনসেন্ট কোম্পানির মত ফুটবলার। এরপর বিশ্বকাপে বড়দেরর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এমন দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোজয়ী রোনালদোর পর্তুগাল, নাইজেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ড। স্বাগতিক রাশিয়াকেও কেউ ছেড়ে দিলে ভুল করবে। সঙ্গে সুয়ারেজ-কাভানির উরুগুয়ে, মোহাম্মেদ সালাহর মিসর গ্রুপ পর্বে বড়দের জন্য বড় বাধা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

আইএইচএস/এমএস