বাংলাদেশের যে সমস্ত পণ্য উৎপাদনে শ্রমের আধিক্য বেশি, সেই সমস্ত পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। আমাদের দেশে তরুণের সংখ্যা বেশি বলে দক্ষিণ এশিয়াতে শ্রমের বাজার তুলনামূলকভাবে সস্তা। সেই সাথে বাংলাদেশের হাতের তৈরি পণ্য উৎপাদনে শত বছরের যে ঐতিহ্য আছে সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের সামজিক ঐতিহ্য একটি শ্রমঘন শিল্পে জায়গা করে নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
Advertisement
আর এ কারণেই কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীর বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশের কাতারে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পণ্যের যে সমস্ত ক্ষেত্র আছে তার মধ্যে পাট পণ্য , বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প, চামড়া,কাঠের তৈরি পণ্য, বাঁশ ও দেশীয় পাতার পণ্য, সিরামিক, ঘরের জন্য ব্যবহারের পণ্য তৈরিতে আমরা যদি যুগের চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইন, পণ্যের মান ও উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করতে পারি তাহলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এই সমস্ত পণ্যের বড় রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবো।
এবার সম্প্রতি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে গিফট ও হাউজওয়ার পণ্যের বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করা সকল প্রতিষ্ঠানে তাদের দেশীয় পণ্যের সমাহার ছিল এবং বিদেশিদের কাছে ব্যাপক সাড়া মেলেছে। তবে এখানে উদ্যোক্তাদের মূল সমস্যা ছিল আর্ন্তজাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনে যে গবেষণা দরকার তার দর্বলতা অনেক বেশি। বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে কী ধরনের রঙ ও ডিজাইন প্রয়োজন তা অনেকেরই জানা নেই।
আমাদের উদ্যোক্তাদের পণ্য উৎপাদেনর জন্য যে দক্ষ মানব সম্পদ দরকার সেই ব্যাপারে যে সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদেরকে আরো জোরালোভাবে এগিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে আমাদের ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প বিকাশে উদ্যোক্তারা একটি সহায়ক প্লাটফর্ম পান।
Advertisement
যার মাধ্যমে আগামীতে ইউরোপসহ অন্যান্য নতুন নতুন দেশে হাতে তৈরি পণ্য বা সেমি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পণ্য বাজার সম্প্রসারণে বাংলাদেশ একটি নতুন ধাপে উন্নয়নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি সহায়তা অতি জরুরি। বিশেষ করে বাজার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে আরো বেশি করে বিদেশী মেলায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা অংশগ্রহণ করতে পারে।
আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে এগিয়ে এসেছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের ভূমিকা অনেক বেশি। তবে বাংলাদেশের পণ্য বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে প্রয়োজন উদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ। আর এধরনের প্রশিক্ষণের সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন নতুন মেশিনারিজের ব্যবহার ও উদ্যোক্তাদের সাথে নতুন পণ্য তৈরিতে উৎসাহের প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, উদ্যোক্তাদের নতুন বাজার তৈরি করতে এবং নতুন নতুন পণ্য নিয়ে রপ্তানী বাজার বাড়াতে। এই নতুন পণ্য তৈরি করে বাংলাদেশের পণ্য নিয়ে নতুন বাজার খুঁজতে আরো বেশি বিদেশী মেলা করার প্রয়োজন। যেখানে দরকার পণ্য ও দেশ উভয়ের ব্রান্ডিং। কারণ উদ্যোক্তারা যে সকল পণ্য নিয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে সেখানে পণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও তুলে ধরছে।
তাই দেশীয় পণ্য তুলে ধরতে পণ্য ও দেশ উভয়ের ব্রান্ডিং দরকার আর সাথে প্রয়োজন উদ্যোক্তাদের শক্তিশালী মানসিকতা। কারণ আমাদের দেশ এসকল গবেষণায় অনেক পিছিয়ে আছে। বন্ধু দেশের মতো আমাদেরও আলাদা এসএমই মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। সাথে এসএমই ব্যাংক। এসএমই মন্ত্রণালয় দেশে নতুন পণ্যের মান, ডিজাইন, রঙ, চাহিদা, প্রশিক্ষণ , মার্কেটিং, ক্রেতা বিক্রেতার সমন্বয় আরো সহজ করে দিবে।
Advertisement
সরকার থেকে সিঙ্গেল ডিজিটে লোন দেয়ার কথা থাকলেও এখনও দেয়া সম্ভব হয়নি। বাজার সম্প্রসারণ করতে হলে গবেষণার কোন বিকল্প নেই । আর এজন্য আলাদা এসএমই মন্ত্রণালয় ও এসএমই সেল দেশীয় পণ্যের বিকাশে সহায়তা করবে।
বিদেশের বাজারে হাতের তৈরি পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি । কিন্তু বেশিরভাগ উদ্যোক্তারাই জানেন না, কোন দেশে কোন পণ্যে কি ধরনের রঙের চাহিদা রয়েছে। এছাড়াও পণ্য ব্রান্ডিং করার ক্ষেত্রে সঠিক মার্কেটিং পদ্ধতি না জানায় অনেক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হারিয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেলা জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট এম্বিয়েন্টে এবারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল হাতের তৈরি ন্যাচারাল আরবান প্রডাক্টের। তাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে অবহেলা না করে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য বিকাশের সাথে সাথে সঠিক গাইডলাইনও দরকার। এসএমই ফাউন্ডেশনের ভূমিকা অনেক বেশি থাকলেও গ্রামীণ অনেক উদ্যোক্তাই শুরুর আগেই হারিয়ে যাচ্ছে সঠিক ব্যবসায়িক কাঠামো না থাকায়।
আর পারিবারিক ও সামাজিক বাধা তো রয়েছেই। এছাড়া ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছে না উদ্যোক্তাদের। তাই উদ্যোক্তাদের যত ক্ষোভ সব যেন ব্যাংকের উপর। ব্যাংকগুলোর উচিৎ মেলা করার ক্ষেত্রে বিশেষ স্কিম চালু করা। তাই গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ হতে পারে শহুরেদের হাত ধরেই।
আমাদের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের আরো দক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের সামনের দিকে নিয়ে আসার প্রয়োজন রয়েছে। আর বাংলাদেশি পণ্যের সম্ভাবনার বাজার ইউরোপে হতে পারে যদি উদ্যোক্তাদের সঠিক পণ্য বিশ্ব বাজারে তুলে ধরা যায়।
লেখক : উদ্যোক্তা।
এইচআর/পিআর