জাতীয়

নিজস্ব সম্পদেই আত্মনির্ভরশীল হতে চায় বাংলাদেশ

বিদেশি দান-দক্ষিণায় নয়, কারো দয়াতেও নয়, নিজেদের সম্পদ দিয়েই আত্মনির্ভরশীল হতে চায় বাংলাদেশ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বহুদূর এগিয়েছে দেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সনদ পেয়েছে জাতিসংঘের কাছ থেকে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে এরই মধ্যে সম্মানজনক অবস্থানে এসেছে। এ কারণে স্বাধীনতার ৪৮তম দিবসে এমন স্বপ্নটা দেখতেই পারে বাংলাদেশ।

Advertisement

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের সময় কেবল অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যেই নয়, আর্থ-সামাজিক নানা সূচকেই অনেক পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় চরম দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। আর স্বাধীনতার পর গত চার দশকে বিদেশি রাষ্ট্রের শোষণমুক্ত বাংলাদেশ বেশ পুষ্ট হয়েছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বহু পথ এগিয়েছে। পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প কোনো প্রকার বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জিডিপির আকার এখন ২১ লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৪তম। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩৩তম। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রথম তিন বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন ৬ শতাংশের বেশি। ওই সময় দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। এখন তা কমে নেমেছে অর্ধেকে।

বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটরস ডাটাবেস ও আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে ৫৮তম অবস্থানে ছিল। ২০১৫ সালে ২০৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার জিডিপি অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির আঙিনায় ১৪ ধাপ উপরে উঠে ৪৪তম স্থানে অবস্থান করছে।

Advertisement

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শূন্য হতে শুরু করে বছর বছর ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। প্রথম প্রজন্মের হাতে গড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমানে রূপান্তর হচ্ছে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা কোনো অংশেই কম নয়। তবে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি, নীতিনির্ধারকদের দেশপ্রেমের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে প্রত্যাশিত গতি আসেনি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) হবে ১,২৩০ ডলার অথবা আরও বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬১০ ডলার (বর্তমানে প্রায় ১,৭০০ ডলার)। একটি দেশের মানবসম্পদ সূচক, হিউম্যান অ্যাসেটস ইনডেস্ক (এইচএআই) অবশ্যই ৬৬ অথবা বেশি এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, ইকোনমিক ভালনারেবিলিটি ইনডেস্ক (ইভিআই) ৩২ অথবা নিচে থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সূচক যথাক্রমে ৭২ দশমিক ৯ এবং ২৪ দশমিক ৮।

২০০৫-২০০৬ সালে রফতানির পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে যা ৩৪ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন হয়েছে। জিডিপি’র আকার ছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা যা বর্তমানে হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি ডাবল ডিজিট থেকে নেমে বছরের এ সময় নাগাদ ৫ দশমিক ৭ ভাগ হয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়ে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। আমাদের বাজেট অতীতের থেকে চারগুণের বেশি বেড়ে বর্তমানে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা হয়েছে। এডিপি ১৯ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩২ শ’ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের উপরে হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে।

গত বছর ইউনেস্কো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত ৭ মার্চের ভাষণ 'বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য' হিসেবে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দি ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভূক্ত করেছে। ৭ মার্চের ভাষণ এখন শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়, এটি বিশ্বের সম্পদ। এটাও বাংলাদেশের জন্য বড় একটা অর্জন।

Advertisement

২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক অনুষ্ঠানে এসে বাংলাদেশের গৌরবময় অর্জনের কথা শুনিয়ে যান নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অগ্রগতির ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, যারা এক সময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল তারা আজ এ দেশকে ‘উন্নয়নের মডেল’ মনে করছে।

স্বাধীনতার পর গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির এ অর্জনকে ‘রোল মডেল’ মনে করছে বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ। অনেক ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারী শিক্ষা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মতো বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি নজর কেড়েছে বিশ্বসম্প্রদায়ের। স্বাধীনতার ৪৮তম দিবসের ঊষালগ্নে এসে দেশের অর্থনীতির আরও মজবুত ভীত গড়ার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার এতো বছরে আমাদের অর্জন ও সম্ভাবনা অনেক। তবে স্বাধীনতার পর থেকে যে ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছিল -তা এক সময় স্লো হয়ে যায়। তাই বলবো, এ অর্জন আরও আগে হতে পারতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে সব সময় একটি ব্যবধান থাকে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হচ্ছে একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়া। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বাংলাদেশ গড়া। সেই দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমি আশা করি, এ পথ-পরিক্রমা ধরে রাখতে পারলে নিশ্চিয়ই একদিন আমরা প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবো।

এফএইচএস/এমবিআর/জেআইএম