ক্রিকেট রাজাদের খেলা। এক সময় এমনই মনে করা হতো। এ কারণেই ক্রিকেটকে বলা হয় ‘রাজকীয় খেলা’। অভিজাতদের খেলাও বলা হয়ে থাকে একে। ব্রিটিশ অভিজাতরাই মূলতঃ ছিলেন ক্রিকেটের ধারক-বাহক। ব্রিটিশদের কাছ থেকেই ধীরে ধীরে ছড়িয়েছে রাজকীয় খেলাটি। ইতিহাসের পথ-পরিক্রমায় অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মধ্যকার শুরু হয়েছিল আধুনিক ক্রিকেটের, সেটাও ১৮৭৬-৭৭ সালে। সেই থেকেই যেন ক্রিকেটের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে গেছে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড। খেলাটির সবচেয়ে কুলিন শ্রেণি হিসেবেও বিবেচনায় আনা হয় তাদের।
Advertisement
যদিও সময়ের বিবর্তনে কখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কখনও দক্ষিণ আফ্রিকা আবার কখনও ভারত তাদের সেই কুলিণত্বে ভাগ বসিয়েছে। বাজার অর্থণীতির কারণে বিশ্ব ক্রিকেট প্রশাসনে এখন ভারতেরই হয়তো একচেটিয়া অবস্থান এবং প্রভাবটা বেশি; কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড তো আদি এবং অকৃত্রিম। তাদের অগোচরে ক্রিকেট বিশ্বে একটি চুলও যেন নড়তে পারবে না। এ কারণেই তো দেখা যায়, ভারত-অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড মিলে গড়েছিল ‘বিগ থ্রি’। অথ্যাৎ তিন মোড়ল।
যদিও সাম্রাজ্যবাদী এই নীতি থেকে ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা আইসিসিকে সরিয়ে এনেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান এবং ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট শশাঙ্ক মনোহর। তবুও, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বিগ থ্রি’র ছায়া থেকে আইসিসি সহসা বের হতে পারবে কি না তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে।
ক্রিকেটের আইন, নিয়ম-কানুন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের একাধিপত্য। এখানে কারও কোনো কিছু বলা বা করার সুযোগ নেই। আদিকাল থেকেই বলতে গেলে ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করছে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড। এককভাবে কারও আধিপত্যের কথা বলতে গেলে, অস্ট্রেলিয়ার নামই উঠে আসবে সবার আগে। একে তো মাঠের খেলায় রয়েছে তাদের আধিপত্য। কী টেস্ট আর কী ওয়ানডে- কোথায় আধিপত্য নেই তাদের! সাম্প্রতিক সময়ে এসে কিছুটা ব্যাকফুটে; কিন্তু এসব সময়গুলোকে তারা মনে করে ‘ট্রানজিশনাল পিরিয়ড’। ঘুরে আবার তারা দাঁড়াবেই। এমনই তাদের ক্রিকেট অবকাঠামো।
Advertisement
মোট কথা, ক্রিকেটে সবচেয়ে ভদ্রলোকের তকমাধারী কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরাই। নাক উঁচা বৃটিশরাও ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার সামনে থাকে জোজন জোজন পিছিয়ে। বিখ্যাত অ্যাশেজের নাম করণই তো হয়েছে অস্ট্রেলিয়াদের গুঁড়িয়ে দেয়া ইংলিশ ক্রিকেটের ছাই-ভস্মের ওপর দাঁড়িয়ে। ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সাম্রাজ্যে হানা দেয়াই যেন দুঃসাধ্য অন্য কারও। এই বিশ্বকাপটার অর্থ দাঁড়িয়েছে এমন- বিশ্বকাপ খেলতে নামবে সবাই। টুর্নামেন্ট শেষে চ্যাম্পিয়ন দলটির নাম অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়া কুলীনত্বের কথা,তাদের ক্রিকেট সংস্কৃতির কথা লিখতে গেলে ভলিউম ভলিউম শেষ হয়ে যাবে হয়তো; কিন্তু সব কিছু লেখা শেষ হবে না। নিজেদেরকে তারা সব সময়ই মনে করে থাকে ক্রিকেট বিশ্বের সুপার পাওয়ার হিসেবে। সেই দলটিই কি না, এমন এক লজ্জায় জড়িয়ে পড়লো- যা নিয়ে এখন সারা ক্রিকেট বিশ্বেই চলছে ছি! ছি!! ছি!!!
অস্ট্রেলিয়ানরা যে আদতেই ভদ্রতার মুখোশ পরা, এটা আগে যতটা বোঝা গিয়েছিল কিংবা প্রমাণ হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি প্রমাণ হলো এবার। ভদ্রতার মুখোশই তো পুরোপুরি খুলে গেলো অসি ক্রিকেটের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কেপটাউন টেস্টে প্রকাশ্যে বল টেম্পারিং করার পর ধরা পড়ে যাওয়ায় উপায়ন্তর না দেখে সেটাকে স্বীকারও করে নিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ এবং বল টেম্পারিং যিনি করেছেন সেই ক্যামেরন বেনক্রফট।
বেনক্রফট নিজেই জানিয়েছেন ঘটনাটা। তিনি জানান, তার পকেটে একটা আঠালো সিরিশ কাগজ ছিল। যেটা তিনি মাঝে মধ্যে পিচে ঘষে নিচ্ছিলেন। যাতে পিচের ধুলো-বালি তাতে আটকে যায়। এরপর সেই খড়খড়ে দিকটা বলে ঘষছিলেন তিনি বল বিকৃত করার জন্য।
Advertisement
এরপর ঘটনাটা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেন স্মিথ। এ জন্য দুঃখপ্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যা হয়েছে, এর জন্য আমি দুঃখিত। আমার নেতৃত্বে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল। আর এটাই শেষ। আমরা এ ভাবে কিছুটা সুবিধা পাওয়ার কথা ভেবেছিলাম। দলের সিনিয়ররা ওয়াকিবহাল ছিল। তবে কোচরা জানতেন না।’
স্মিথ এর আগে ভারত সফরে এসে ড্রেসিং রুমের দিকে তাকিয়ে ডিআরএস নেয়ার যে ঘটনা ঘটিয়েছিলেন সেটাও ছিল চরম অভদ্র একটি কাজ। যে ঘটনার জের ধরে মুখোমুখি অবস্থানে চলে গিয়েছিল ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া- দু’দেশেরই ক্রিকেট বোর্ড। আইসিসির কাছে নালিশ আর পাল্টা নালিশের পর্ব চলেছিল বেশ। যে কারণে আইসিসিও তাদের কাছে হার মেনে নিজেরা যেন মীমাংসা করে নেয়। সবশেষে সে পথেই হেঁটেছিল দুই বোর্ড। সবই হয়েছিল, মাঠের মধ্যে স্মিথের অভব্য আচরণের কারণে।
কিন্তু এবার যা করলেন তিনি, তাতে পুরো অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটেরই ভদ্রতার মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেলো। বল টেম্পারিং ক্রিকেটে বেশ পুরনো রোগ। পাকিস্তান এবং ভারতীয় ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে হামেশাই বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ উঠতো। কয়েকদিন আগে ইংলিশ অধিনায়ক জো রুটের বিরুদ্ধেও উঠেছিল এমন অভিযোগ; কিন্তু এভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে বলকে শিরিস কাগজ দিয়ে ঘষে বিকৃত করা- কে কবে ভাবতে পেরেছিল! অসভ্য, অভদ্র কেউ ছাড়া তো এমন কাজ কেউ করতে পারে না। অথচ, স্টিভেন স্মিথ জানিয়েছেন- পুরো দলই জানতো বিষয়টা। তারা সবাই পরামর্শ করেই এ কাজ করেছিল। সুতরাং, অভদ্র, ক্রিকেট স্পিরিটকে নষ্ট করার কাজ করেছিল অস্ট্রেলিয়া দলের সব ক্রিকেটারই।
উপমহাদেশের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে অস্ট্রেলিয়ানরা যে বড় গলায় এর তীব্র নিন্দা করতো, তীরস্কার করতো- সেই বড় গলা আর থাকলো না তাদের। গ্রেগ চ্যাপেলরা তো পারলে যেন উপমহাদেশের ক্রিকেটকেই নিষিদ্ধ করে দেন। সেখানে তাদের দেশেরই সভ্য ক্রিকেটাররা নির্লজ্জ বল টেম্পারিং করেন।
মুত্তিয়া মুরালিধরনের মত ক্রিকেটারের বলকে সহ্য করতে না পেরে অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার তার বলকে ডাকেন নো বল। প্রতিবাদে অর্জুনা রানাতুঙ্গারা দলবল নিয়ে মাঠ ছেড়ে উঠে যান। অস্ট্রেলিয়ানদের স্লেজিং সর্বজনবিধিত। কোনো সিরিজ শুরুর আগে কথার বাক্যবানে প্রতিপক্ষকে বিদ্ধস্ত করে তোলাটা যেন তাদের জাতীয় স্বভাব। এছাড়া ভারতের বিপক্ষে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসদের মাঙ্কিগেট কেলেঙ্কারির কথা কে না জানে! তবুও ভদ্রতার মুখোশ সব সময় পরে থাকে তারা। এবার সেই মুখোশ পুরোপুরি খুলে গেলো স্টিভেন স্মিথদের কল্যাণে।
আইএইচএস/আরআইপি