১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এক নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। তাই ২৫ মার্চ বাঙালির জীবনে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত। সেই কালরাতের স্মরণে দেশমাতার কাছে চিঠি লিখেছেন জুনায়েদ নাঈম-
Advertisement
মা,অনেকদিন পর তোমায় লিখছি। আজ এক বিশেষ দিন। দলছুট হয়ে অনেক ঘুরে এই দিনটাতেই বারবার তোমার কথাই মনে পড়ে। পঁচিশের ওই রাতে তোমাকে ওরা বড় কষ্ট দিয়েছিল, তাই না মা। সে রাতে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। তার আগেই হুট করে কেমন করে যেন অনেক কিছু ঘটে গেল। হানাদাররা রাতের অন্ধকারে নরপিশাচ সেজে ঘুরে বেড়ায় আর ছিন্ন করে তোমার বুক আকড়ে থাকা সন্তানকে।
আমি সেই রাতে কিভাবে যেন ওই নরপিশাচগুলোর হাতে পড়ে গেলাম। খোকনের জ্বর বলে শীলা আমায় ডাক্তার ডাকতে পাঠায়। ডাক্তার বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারিনি মা। তার আগেই পাকহানাদারগুলো আমায় পাকড়াও করে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে ওদের লরিতে উঠায়। তারপর কোথায় নিয়ে যেন দাঁড় করায়। আমার সাথে আরো অনেকেই ছিলো- সারি ধরে। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…’ শেষ হওয়ার আগেই কটকট শব্দে রাইফেলগুলো থেকে গুলি ছোটে।
সে কী ভীষণ চিৎকার! বুকে গুলির ব্যথা আর কানবন্ধ করা আর্তচিৎকারে সেদিন এমন একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি হলো যে, তোমাকে আর কিছু বলে যেতে পারলাম না। তারপর তো সারি সারি লাশের ভিড়ে মাটিচাপা পড়লাম। আমার জানাজাটাও হলো না মা। পলাশডাঙ্গার ছাপড়া মসজিদের ইমামের ছেলে আজ জানাজা পেলো না মা। আমার মতো হাজারও মানুষ এভাবে হারিয়ে গেল সেই রাতে, তলিয়ে গেল তোমার হাড়-পাজড়ে।
Advertisement
পরে জেনেছি, খোকনকে নিয়ে শীলা একাই পরদিন গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিল। কিভাবে কী করে যেন ওরা সেই রক্তাক্ত দিনে বেঁচে যায়। আজ আমার হারিয়ে যাওয়ার দিন মা। তার চেয়ে অনেক বড়- আজ তোমাকে আপন করে পাওয়ার দিন।
কাল স্বাধীনতা দিবস মা! এইদিনেই তোমার হাজারও সন্তান জেগেছিল মা। চিৎকার করে স্বাধীনতা দাবি করেছিল সবাই। তার পরের গল্প তোমার চেয়ে ভালো কে জানে? জানো মা, খোকন এখন অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। ২৬ তারিখ ও বধ্যভূমিতে ঘুরে বেড়ায়, আমাকে কোথায় মেরেছিল জানে না তো- তাই সবখানেই আমায় খুঁজে বেড়ায়। সব জায়গায় গিয়ে ওর গল্প বলে। ওর নাকি একটা ছেলে আর একটা পরীর মতো মেয়ে। ওরা পড়াশোনার জন্য নাকি দেশের বাইরে গেছে।
সেদিন দেখি, হাতে এক কপি ছবি নিয়ে এসেছে। ওর সন্তানসহ আরও ছেলেমেয়েরা প্রবাসে নাকি আজকের দিন স্মরণ করে ওকে চিঠি লিখেছে। চিঠিটা পড়েও শোনালো খোকন। ওর সন্তানরা যুদ্ধ দেখেনি- তবে বিজয় দেখেছে। তারা স্বাধীনতার সেই ইতিহাস আজও মনে রেখেছে। মনে রেখেছে প্রত্যেক বীরাঙ্গনা, শহীদ, মুক্তিযোদ্ধার অবদান। ওরা আজও তোমার ভাষায় কথা বলে মা। ওরা তোমার ভাষায় তোমাকে চিঠি লেখে।
আজ যাই মা। আমার এই চিঠিতে খোকনের রেখে যাওয়া প্রবাসে থাকা আগামী প্রজন্মের ছবিটা দিয়ে দিলাম। ওরা ফিরবে মা। ওরা তোমার গল্প সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেবে। তোমার ঘর আবার গুছিয়ে দেবে। ওরা সুতো ছেড়া ঘুড়ির মতো হারাবে না। নীড়ে ফেরা পাখির মতোই তোমার বুকে ফিরে আসবে।
Advertisement
ইতি, তোমার আদরের সন্তান
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
এসইউ/পিআর