সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর সবাই অপেক্ষা করছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া হবে, তিনিই হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তবে সবাই জানতেন এটা কখনোই হবে না। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা তুলে দেবেন না। ভুট্টো কখনোই তা হতে দেবেন না।
Advertisement
চলছিল নানান টালবাহানা। ফুঁসছিল বাঙালি। ২৪ বছরের গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত হতে তারা তখন ছটফট করছে। শুধু মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা। ভুট্টোর চালে ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিয়ে অখন্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিল লম্পট ইয়াহিয়া খান, কুড়াল মারল নিজের পায়ে।
বারুদ হয়ে ওঠা বাঙালির মধ্যে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিল ইয়াহিয়ার ঘোষণা। মানুষ নেমে এলো রাস্তায়। ঢাকা স্টেডিয়ামে টেস্ট খেলা পন্ড হয়ে গেল। মার্চের প্রথম দিন থেকেই আসলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ রইলো না। সবকিছু চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। বাঙালিরা তো জানেই, পশ্চিমা শাসকরাও বুঝে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে আর তারা রাখতে পারবে না। তখন চলছিল একটা কৌশলের খেলা- হামলাটা কে আগে চালাবে।
পাকিস্তানীরা একের পর এক উস্কানি দিয়ে যাচ্ছিল, যাতে বঙ্গবন্ধুর ধৈর্যে্যর বাঁধ ভেঙ্গে যায়। যাতে বাঙালি সহিংস পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়েও ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। তিনি জানেন, জনগণ তাঁর সঙ্গে আছে, জনগণের বৈধ রায় তাঁর সঙ্গে আছে। তাঁকে শুধু ঠান্ডা মাথায় স্বাধীনতার অনিবার্য গন্তব্যে জাতিকে পৌঁছে দিতে হবে।
Advertisement
৭ মার্চ এলো আরেকটি অগ্নিপরীক্ষা। তখনকার রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ মানুষ। উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। রেসকোর্সের আকাশে উড়ছে সেনা হেলিকপ্টার। ক্যান্টনমেন্টে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন, খালি আদেশের অপেক্ষা। স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো কিছু দিয়ে এই ১০ লাখ মানুষকে ঘরে ফেরানো দায়। আবার বঙ্গবন্ধু এটাও জানেন, বাঙালিরা যেমন তেমনি পাকিস্তানীরাও স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে।
ঘোষণা এলেই বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আর বঙ্গবন্ধুকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে তারা। কী করবেন বঙ্গবন্ধু? দারুণ দোটানা, উভয়সঙ্কট। মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তুলে ধরলেন ২৪ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস, ধারণ করলেন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির আবেগ। ভাষণ শেষ করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে।
কী অসাধারণ কৌশল! বাঙালির ঘরে ফিরলো স্বাধীনতার আকাঙ্খা আর ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে। পাকিস্তানীরা থমকে গেল। তারপরও চললো সেই কৌশলের খেলা। আলোচনার নামে চললো কালক্ষেপণ আর সৈন্য সমাবেশ।
২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান চোরের মত পালিয়ে গেল। আর রাতেই শুরু হলো ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সার বেঁধে বের হলো হায়েনারা। ট্যাংক, কামান আর রাইফেল নিয়ে। টার্গেট পূর্ব নির্ধারিত। প্রতিরোধকে গুঁড়িয়ে দিতে পিলখানা, পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল আর জগন্নাথ হল, পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যূষিত এলাকায় শুরু হলো নৃশংস গণহত্যা।
Advertisement
হানাদাররা তুলে নেয়ার আগে বঙ্গবন্ধু দিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খান ঘোষণা দিলেন পোড়ামাটি নীতির, তারা পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চায় শুধু, মানুষ চায় না। তারপর ৯ মাস ধরে চললো তাদের এই আকাঙ্খার নিষ্ঠুর বাস্তবায়ন। টিক্কা খানের পর নিয়াজী এসে ঘোষণা দিল, বাঙালির জাতি গঠনই বদলে দেয়ার। তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিল বাঙালি নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করতে।
সাধারণ সন্ত্রাস, হত্যার সাথে গণহত্যার সুষ্পষ্ট পার্থক্য। আপনি যখন একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্য নিয়ে অভিযান চালাবেন, সংখ্যা যাই হোক, সেটা গণহত্যা। পাকিস্তানী হানাদাররা ৯ মাস বাংলাদেশে চালিয়েছিল নিষ্ঠুর গণহত্যা। মাত্র ৯ মানে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করার উদাহরণ বিশ্বেই বিরল। নৃশংসতায় ইয়াহিয়া খান ছাড়িয়ে গিয়েছিল চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, হিটলারকেও। গিনেস বুক বলছে, বিংশ শতাব্দীর শীর্ষ ৫ গণহত্যার একটি নিরীহ বাঙালির ওপর চালানো পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞ। ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার বার্ষিকীর প্রতিবেদনে বলা হয়, গণহত্যার ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বল্পতম সময়ে বেশি মানুষ হত্যা হয়েছে।
গণহত্যার ব্যাপারটি বোঝার জন্য নজর দেয়া যেতে পারে রাখাইন রাজ্যে। সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যা করছে, আকারে ছোট হলেও সেটা গণহত্যা। মিয়ানমার যেমন রাখাইন রাজ্যের মাটি চাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের চাচ্ছে না। ইয়াহিয়াও তেমনি বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। গণহত্যা হলো, অপরাধের সর্বোচ্চ মাত্রা। এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই, এই অপরাধ কখনো তামাদি হয় না।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশ্য আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানেই বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনও পাকিস্তানী হানাদারদের মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছিল। সে কারণে সে কমিশনের রিপোর্ট আর কখনো আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশও প্রাথমিকভাবে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির দোহাই দিয়ে সেই যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। কথা ছিল তারা সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। করেনি।
গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধ নিছক কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা গোত্রের বিরুদ্ধে হয় না, হয় গোটা মানবতার বিরুদ্ধে। তাই মানবতাবিরোধী অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। আর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষমা করে দেয়ার কোনো অধিকারও কারো নেই। মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে এটাই আন্তর্জাতিক রীতি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ব্যাপারে এই নীতিই অনুসৃত হয়ে আসছে। বছরের পর বছর পালিয়ে থেকেও যুদ্ধাপরাধীরা রেহাই পাননি। পাওয়ামাত্র তাদের ধরা হয়েছে, সাজা হয়েছে।
কিন্তু পাকিস্তান কখনো তাদের অপরাধ স্বীকার করেনি, ক্ষমা চায়নি। পাকিস্তান তাদের সেনা কর্মকর্তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো করেইনি, বরং এখন তারা আস্তে আস্তে গণহত্যাকেই অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। এই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারলো না পাকিস্তান, এটা কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে তাদের ব্যর্থতা। একই ব্যর্থতা ছিল বাংলাদেশেরও। বাংলাদেশ যখন সেই গ্লানি মোচনের উদ্যোগ নিল, তখন জ্বলুনি শুরু হলো পাকিস্তানে। তারা ফাঁসি হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের গায়েবানা জানাযা পড়ে, সংসদে শোক প্রস্তাব এনে প্রমাণ করলো, এই অপরাধের দায় তাদেরও।
বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই গঠন করেছিলেন ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩’। বঙ্গবন্ধু সে বিচার করে যেতে পারেননি। তবে তাঁর কন্যা আমাদের সেই গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছেন। একাত্তরে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলেও তখন আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের প্রভাব বেশি ছিল। শিশু রাষ্ট্র বাংলাদেশের সামনে ছিল কঠিন সব চ্যালেঞ্জ। আর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে পাকিস্তানী ভাবধারায়। তাই একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি।
গতবছর থেকে বাংলাদেশ ২৫ মার্চকে স্মরণ করছে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এখন সময় পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আন্তর্জাতিক মহলে তোলার। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের। একাত্তরে পাকিস্তানীদের গণহত্যার সব প্রমাণ এখনও আছে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজারো গণকবর। যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাদের কান্না এখনও গুমড়ে কাঁদে বাতাসে।
পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যার দায় অস্বীকার করছে। একাত্তরের মত এখনও তাদের সাথে সুর মেলায় তাদের এদেশীয় কিছু দোসর। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে। পরে ধাপে ধাপে ফিরিয়ে নেয় তাদের যুদ্ধবন্দী সৈনিকদেরও। কিন্তু তাও এদেশে কিছু পাকিস্তানী আটকা পড়ে গেছে। এদের কিছু সত্যিই পাকিস্তানী, যারা থাকেন বিভিন্ন ক্যাম্পে। আর কিছু আছে চেতনায় পাকিস্তানী। এরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, রাজনীতি করে, ক্ষমতায় আসে, বড় বড় কথা বলে। পাকিস্তানের সাথে সুর মিলিয়ে তারাও বলতে চায়, একাত্তর সালে মানুষ মরেছে বটে, তবে ৩০ লাখ নয়। যেন পাকিস্তানের অপরাধ কমিয়ে দেখাতে পারলে আনন্দ হয়। পাকিস্তানের অপরাধ কমিয়ে দেখাতে, আমাদের অর্জনকে খাটো করতে তারা বলে, ৩০ লাখ যদি মারা যাবেই, তবে তাদের তালিকা করা হোক। সময় এসেছে তাদেরও প্রতিরোধের। যারা এই দেশটা চায়নি, এই দেশটা তাদের নয়। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ কখনো তামাদি হয় না। পাকিস্তানীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, তাদের অপরাধ। এদেশের যারা এখনও হৃদয়ে পাকিস্তান ধারণ করে, তাদেরও বুঝিয়ে দিতে এই দেশটা স্বাধীন, সার্বভৌম। যারা এই দেশের বিরুদ্ধে, এই দেশে তাদের কোনো ঠাঁই নেই।
২৪ মার্চ, ২০১৮
এইচআর/এমএস