মতামত

প্রাণের মানুষ কই?

 

একটি প্রচলিত বাক্য রয়েছে, ''কথা বলা শিখতে একজন মানুষের দুই বছর সময় লাগে, কিন্তু কি বলা উচিত নয় এবং কোথায় কি বলতে হবে তা জানতে লাগে সারাজীবন।'' তেমনি মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষত ফেসবুকে কিছু মানুষের উদ্ভট কর্মকাণ্ড দেখে প্রশ্ন জাগে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহারে সচেতনতা দরকার, এটি বুঝতে তাদের কত সময় লাগবে?

Advertisement

অতি সম্প্রতি তেমনি একটি ফেসবুক পোস্টে চোখ আটকে গেলো এবং সারাদিন এই পোস্টে ব্যবহৃত নৃশংস ছবিগুলো শেলের মতো বুকে বিঁধেছে। চট্টগ্রামের একজন বাসিন্দা সেই ছবিগুলো পোস্ট করেছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, ছাদ থেকে ঝুলে আছে একটি বিড়াল, তার গলায় বাঁধা রয়েছে দড়ি! উৎসুক বাচ্চারা মাথা ঝুঁকিয়ে দেখছে বিড়ালটিকে।

পোস্টটি পড়ার আগে আমি ভাবছিলাম, এটা কি নতুন কোন খেলা? কিংবা বাচ্চাদের এতো উৎসুক্যের কারণ বুঝিবা বিড়ালটিকে কোনো বিপদ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে, সেটি দেখা। কিন্তু ঘটনাটি একেবারেই বিপরীত এবং প্রচণ্ড করুণ সেই বিড়ালের জন্য। কারণ, পোস্টের বর্ণনায় রয়েছে, বিড়ালটিকে এই উপায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, বিড়ালটি তাদের কবুতর খেয়ে ফেলেছে তাই! এটুকু পড়তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে তাই দ্বিতীয়বার তাতে চোখ বোলানোর সাহস করিনাই।

মনে পড়ে গেলো, ''বাবুরাম সাপুড়ে''র কথা। সাপুড়ের কাছে আবদার একটি নিরীহ সাপের জন্য। সেই সাপের শিং, নখ নেই, ছোটে না, হাঁটে না, কাউকে কাটে না। শুধু দুধ ভাত খায়। অথচ সেই সাপটিকেই ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেবার পরিকল্পনা। কেন এই অদ্ভূত চিন্তা? বিষ প্রশমন করেই তো সাপকে বশ মানিয়েছে সাপুড়ে। সে কি আর মানুষের ক্ষতি করবে?

Advertisement

যাহোক, নিরীহ বিষহীন সাপই রেহাই পায়না, বিড়ালের অপরাধ সেই অর্থে গুরুতর! সে তো শাস্তি পাবেই! আমাদের দেশে যেখানে মানুষের জীবনেরই নিরাপত্তা নাই, পশু হত্যা নিয়ে হাপিত্যেশ সেখানে কৌতুকের কারণ হতেই পারে অনেকের কাছে। তবুও কিছু কথা প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় লিখছি।

সুস্বাস্থ্য ও সুখী জীবনের জন্য, শৈশবে বেড়ে ওঠার সময়টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সেই প্রক্রিয়ায় শিশুদের পরিবেশ, প্রতিবেশ, পৃথিবীর নানা উপাদানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, পশুপাখির নীরব অথচ চমৎকার অবদান থেকে যায়। শিশু কথা বলতে শেখারও আগে প্রাণী কেমন শব্দ করে, তা হুবহু উৎপাদন করে মনুষ্য সমাজে সামিল হয়।

বর্ণপরিচয়ের সময়, বইয়ে বর্ণের পাশে যে ছবি থাকে, তার অধিকাংশই পশুপাখির। অর্থ্যাৎ শব্দ উৎপাদনে পশুর অবদান রয়েছে। এছাড়াও শিশুদের জন্য নির্মিত কার্টুন, এনিমেটেড ফিল্ম, রাইমস সবকিছুতেই পশুপাখির জয়। পোষ্য প্রাণী তো রয়েছেই। কিন্তু তারপরও পরবর্তীতে আমরা বেমালুম ভুলে যাই প্রাণীগুলোকে, তাদের এই সূক্ষ অবদানকে।

অথচ বিস্তর গবেষণায় প্রমাণিত, শিশু ও পশুপাখির মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখে। শিশুদের সামাজিক, মানসিক, জ্ঞানীয় বিকাশে পশুপাখির ভূমিকা নিরবচ্ছিন্ন। পশুর প্রতি সহনশীলতা শিশুকে দয়ালু করে তোলে। সংবেদনশীল হতে সাহায্য করে। শিশুরা যেমন জন্মসূত্রে প্রাণীদের প্রতি আকর্ষিত হয়, তেমনি পোষ্য পশুরাও আবেগীয় বৈশিষ্ট্য তৈরিতে প্রচ্ছন্ন ছাপ রাখতে সক্ষম। পশুদের প্রতি যেসব শিশুরা যত্নবান বা স্নেহপ্রবণ, তারা মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল হিসেবে বেড়ে ওঠে।

Advertisement

দারুণ মিষ্টি ও প্রায় সকলের জানা একটি ছড়া আছে, 'হাট্টিমাটিম টিম।' এই হাট্টিমাটিম টিম আবার মাঠে ডিম পাড়ে! তারা কি আদৌ আছে? তবু কাল্পনিক খাঁড়া দুটো শিং দেখাতে হাতের আঙ্গুল মাথায় রেখে তাক করলেই শিশুদের সেকি হাসি! কাল্পনিক এই প্রাণীটিকে ঘিরে ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া অব্দি কেবলই আনন্দ। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কালোত্তীর্ণ 'কাজের আনন্দ' ছড়াটিতে উল্লেখ রয়েছে মৌমাছির, যে নেচে নেচে ফুলের মধু আহরণে যাচ্ছে, তার শিশুবন্ধুর আহবানে দু'দন্ড সাড়া দিয়ে দাঁড়াবার সময় নাই।

ছোট পাখি তৃণলতা জড়ো করেছে বাসা বুনবে, তাই শিশুবন্ধুকে বলছে, ''এখন না ক'ব কথা'' আবার বিষম ব্যস্ত পিপীলিকা দলবল ছেড়েই ছুটছে খাবারের খোঁজে ''ছয় পায়ে পিলপিল।'' পিঁপড়ার যে ছয়টা পা, সে যে শীত আসার আগে খাবার জমায়, ছোট পাখি পরিশ্রম করে তার বাসা বোনে, মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে ফুল থেকে, প্রকৃতির এই অপার বিস্ময়, জীবনের এই চক্রের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ করিয়ে শিশুমনকে কৌতূহলী করে তুলতে প্রাণীদের এই যে ভূমিকা, তা উপেক্ষা করা যাবে?

হিউম্যান অ্যানিমল ইন্টারয়্যাকশন (হাই)-এর গবেষণায় বলা হচ্ছে, শিশু ও তরুণদের মনস্তাত্বিক ও শারীরিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার মত সম্ভাবনা রয়েছে পোষ্য প্রাণীদের। এমনকি যেসব শিশু পারিবারিক অসহিষ্ণু পরিবেশে বেড়ে ওঠে, পোষ্য প্রাণীর প্রতি নির্ভরতার কারণে তার বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।

পশুদের এতসব শক্তিশালী অবদানের পরও পশুরা অরক্ষিত। প্রতিনিয়ত রাস্তায়, ঘরে, জঙ্গলে পশুরা আক্রমণের শিকার হয়। খুব সহজ একটি কথা, আমাদের সকলের জানা, পশু নিজে থেকে কাউকে আক্রমণ করে না, পশু কাউকে হত্যা করে কেবল ক্ষুধা নিবারণের জন্য। অথচ আমরা মানু্ষ ঘরদোর সাজানোর প্রয়োজনে, পরিষ্কার রাখার ছুঁতোয় এক নিমিষেই ক্ষুদ্র একটি মাকড়সার দীর্ঘ অধ্যবসায়ে তৈরি জালও নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি। এই ক্ষমতা আমাদের আছে, ক্ষমতা আছে বলেই অপব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সহনশীল আচরণ তো আমাদের করতে হবে।

ফেসবুকের পোস্টে যেই বিড়ালটি নির্মম হত্যার শিকার, সে ক্ষুধা মিটাতে কবুতর খেয়েছে। এটি তার জীবনচক্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যে কবুতরটি সে খেয়েছে, সেটিও বেঁচে থাকার জন্য তার চাইতে দুর্বল প্রাণী, যেমন কীটপতঙ্গ খেয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য প্রাণীকূলের প্রাকৃতিক এই নির্ভরশীলতা সম্পর্কে ওই শিশুরা কতটুকু জানে? কবুতর মেরে ফেলার অপরাধে বিড়ালটিকে অভিনব উপায়ে হত্যা করে সেটি আবার সোশ্যাল সাইটে আপলোড করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কোন শিশুর মস্তিষ্ক নিঃসৃত, আমি বিশ্বাস করিনা। যিনি শিশুদের মাথায় এধরণের প্রতিশোধ স্পৃহা ঢুকিয়ে দিলেন, তিনি মানসিকভাবে সুস্থ কিনা তা একটু জানা দরকার।

বিড়ালের প্রাণ গেছে, সেই সঙ্গে এই শিশুগুলো নিষ্ঠুরতার শিক্ষা পাচ্ছে। এই অন্যায়ের ভার কে নিবে? এ কোন সমাজের দিকেই বা যাচ্ছি আমরা যেখানে শিশুকে ডায়াপার পড়ানো অবস্থার ছবি ফেসবুকে শেয়ার দেওয়া থেকে শুরু করে বিড়াল মারার কুৎসিত উল্লাসও বাদ যাচ্ছেনা? মানসিক বিকলাঙ্গতা থেকে মুক্তির উপায় তো আমাদের খুঁজতে হবে। সেই পথে হাঁটতে হবে।

শিশুর সুস্থ বিকাশ, তারও যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রয়েছে, অভিভাবক হিসেবে সেটা বোঝার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। নয়তো সমাজের একটা বিরাট অংশ আমাদের কেবল পেছনেই টেনে নিবে, সামনে এগোনো অসম্ভব হয়ে যাবে।

লেখক: সংবাদ উপস্থাপক ও বাচিক শিল্পী

এইচআর/এমএস