রকিবুল হাসান আর মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর মন খারাপ। ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে যেন। রাজ্যের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। রকিবুল ম্যাচ রেফারি। দেশের ম্যাচ রেফারিদের মধ্যে বয়োজৈষ্ঠ। আর নান্নু প্রধান নির্বাচক। পেশাগত দায়িত্ব এবং কর্ম ব্যস্ততায় হয়তো আগের মত ক্লাবে যেতে পারেন না। কিন্তু ঐতিহ্যবাহি মোহামেডানের সাথে যে এ দুজনার নাড়ীর সম্পর্ক।
Advertisement
দুজনই অনেক দিন মোহোমেডানের হয়ে খেলেছেন। নেতৃত্বও দিয়েছেন। তাই সাদা কালো শিবিরের সাথে তাদের বন্ধনটাই অন্য। এ কারণেই মোহামেডান প্রিমিয়ার ক্রিকেটের সুপার লিগ খেলতে না পারায় তাদের মন খারাপ।
জাতীয় দলের এই দুই সাবেক অধিনায়ক ও সব সময়ের অন্যতম দুই সেরা ব্যাটসম্যানের যেন এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না, তাদের প্রিয় দল মোহামেডান এবার ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের সুপার লিগেই ওঠেনি। দেশের ক্রিকেটের এ দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র কিছুতেই মেলাতে পারছেন না, তাদের খেলোয়াড়ী জীবনের সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য সময় যে শিবিরে কেটেছে, সেই ‘মোহামেডান’ এবারের প্রিমিয়ার ক্রিকেটের সুপার লিগে নেই। ১২ দলের প্রথম লিগ শেষে দেশের এ ঐতিহ্যবাহি দলের অবস্থান সাত নম্বরে।
এ এস এম ফারুকের পর ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে মোহামেডানের দ্বিতীয় অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, ‘মোহামেডান শুধু একটি ক্লাব নয়। একটি প্রতিষ্ঠিান। দেশের ক্রীড়াঙ্গানের এক সফল ও ঐতিহ্যবাহি দল। আমি সৌভাগ্যবান যে, ১৯৭৭-১৯৭৮ সালে ভিক্টোরিয়া থেকে মোহামেডানে প্রথম যোগ দিয়েই শিরোপার স্বাদ পাই। তারপর দীর্ঘ দিন সাদা কালো শিবিরে খেলেছি। অধিনায়কত্ব করেছি। লিগ ছাড়া ট্রফিও জিতেছি। কিন্তু সেই সোনালী সাফল্যে মোড়ানো দল কখনো প্রিমিয়ার লিগের সুপার লিগ খেলতে পারবে না, ভাবিনি কখনো। আমি ব্যক্তিগতভাবে হতাশ।’
Advertisement
রকিবুল হাসানের পর আশির দশকে যার কাঁধে বর্তেছিল মোহামেডানের নেতৃত্ব, আজকের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও চরম হতাশ। কন্ঠে রাজ্যের হতাশা নিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয় অনেক অর্জনের শিবির মোহামেডানের এটা একরকম ঐতিহ্যর বিসর্জন। এমন এক দেশ প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় দল সুপার লিগ খেলতে পারবে না ভাবিনি কখনো। তাই বিশ্বাসও হচ্ছে না।’
শুধু রকিবুল হাসান আর মিনহাজুল আবেদিন নান্নুই নন। স্বাধীনতার পর ঢাকা মোহামেডান যেবার প্রথম সিনিয়র ডিভিশন (তখন ওই নামেই ছিল ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের আজকের প্রিমিয়ার লিগ) ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়, সেই ১৯৭৭-১৯৭৮ মৌসুমে মোহামেডান শিবিরের আরেক নিয়মিত সদস্য ওয়াহিদুল গনিও যারপরনাই হতাশ।
জাগো নিউজের সাথে মোহামেডানের সুপার লিগ খেলতে না পারা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মোহামেডান তথা জাতীয় দলের এ সাবেক লেগস্পিনার (মোহাম্মদ আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফীস, মোহাম্মদ শরিফ ও এবারের পেস সেনসেশন কাজী অনিকের গুরু) দুঃখ করে বলেন, ‘মোহামেডানের মত ঐতিহ্যবাহি দল সুপার লিগের বাইরে, মনে হলেই রাজ্যের হতাশা এসে ভর করছে।’
রকিবুল, ওয়াহিদুল গনি আর নান্নুর সাথে সুর মিলিয়েছেন মোহামেডানের আরেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাগো নিউজের সাথে আলাপে বুলবুল বলেন, ‘মোহামেডান সেরা ছয় দলের মধ্যে নেই। সুপার লিগের বাইরে, শুনে খুব কষ্ট পেয়েছি।’
Advertisement
সত্যিই এবার ব্যর্থতার নতুন ইতিহাস মোহামেডানের। স্বাধীনতার পর প্রথম দুই, মতান্তরে তিন মৌসুমে লিগ শিরোপা না পেলেও ১৯৭৭-১৯৭৮ মৌসুমে গিয়ে এ এস এম ফারুকের নেতৃত্বে প্রথমবার লিগ বিজয়ী হয় মোহামেডান।
তারপর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি আবাহনী, আজাদ বয়েজ, বিমান, ব্রাদার্স, ভিক্টোরিয়ার সাথে লড়াই হলেও ফুটবল ও হকির মত ক্রিকেটেও মোহামেডান ঠিকই অন্যতম বড় শক্তি হয়েই ছিল।
সর্বশেষ ২০০৯ সালে খালেদ মাসুদ পাইলটের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়া মোহামেডান গত ছয় লিগে শিরোপা পায়নি। এর মধ্যে গত তিন চার বছর ধরেই মোহামেডান খুব সমৃদ্ধ দল গড়েনি। কাগজে কলমে তিন চার নম্বর দল ছিল। আর এবার প্লেয়ার্স বাই চয়েজে দলবদলের পরই বোঝা যাচ্ছিলো মোহামেডান ভালো দল হয়নি।
শামসুর রহমান শুভ, রনি তালুকদার, রকিবুল হাসান, তাইজুল ইসলাম, শুভাশীষ রায় আর যুব দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলে আসা পেসার কাজী অনিক ছাড়া একঝাঁক আনকোরা ক্রিকেটারে সাজানো দলটি কাল শেষ ম্যাচে কলাবাগানের সাথে জিতেও সেরা ছয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি।
সবচেয়ে সর্বনাশ হয়েছে গাজী গ্রুপকে ১২৮ রানে বেঁধে ফেলেও জিততে না পারায়। ওই ম্যাচে দুই পয়েন্ট পেলে পয়েন্ট দাঁড়াতো ১৩। তাতে অনায়াসে সেরা ছয়ে জায়গা হয়ে যেত মোহামেডানের।
প্রিয় দলের ব্যর্থতায় ভক্ত ও সমর্থকরাও ভীষণ হতাশ। এক মোহামেডান অন্তঃপ্রাণ সমর্থক মনের দুঃখে বলেই ফেললেন, ‘আরে ফুটবল আর হকিতে সুপার লিগ না খেলার রেকর্ড আছে। কিন্তু ক্রিকেটে ছিল না কখনো।’
ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৯৭৪ সালে ঢাকার ফুটবল লিগে সুপার লিগ খেলতে পারেনি মোহামেডান। আর ১৯৭৭ সালে সুপার লিগে উঠে একটি ম্যাচও জেতেনি। কিন্তু ক্রিকেটে সুপার লিগ না খেলার রেকর্ড ছিল না কখনো। এবারই প্রথম সাদা কালোরা সেরা ছয়ের বাইরে।
মোহামেডানের স্বর্ণ সময়ের অন্যতম সারথি রকিবুল হাসান, ওয়াহিদুল গনি ও মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর মনে ও কন্ঠে এ ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার জোর তাগিদ। তাদের কথা, মোহামেডান বড় দল। ঐহিত্যবাহি ক্লাব। জনপ্রিয় ক্রীড়া শক্তি। এই দলের সাথে সাফল্যই মানায়। ব্যর্থতা মানায় না। কাজেই আগামীতে ভালো করার দিকে নজর দিতে হবে।
রকিবুল আর নান্নু প্রায় একই সুরে বলে ওঠেন, একটা ভালো ও দক্ষ কোচ, সাথে ক্রিকেট জ্ঞান, বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন টিম ম্যানেজমেন্ট খুব জরুরি।
তারা মনে করছেন, ভালো দলের পূর্বশর্ত ভালো ও দক্ষ ম্যানেজমেন্ট। সেটা আগে নিশ্চিত করে একটা ভালো লাইন আপ দাঁড় করিয়ে দিলে অবশ্যই ভালো ফল আসবে। তা না করে যেনতেন ভাবে দল সাজালে ফল হবে না।
এআরবি/এমএমআর/এমএস