চৈত্র সংক্রান্তি সেদিন। ভরদুপুরের উত্তাপে চান্দি ফেটে মগজ গলছে যেন। গাড়ির সিসা গলা ধোঁয়া আর পিচঢালা তাপ মিলে আগুনে ঘি ঢালছে আরও। কলকাতা নিউ টাউন থেকে মেট্রোতে চেপে শোভাবাজার স্টেশন মুখে আসতেই প্রশস্ত সড়কে মরীচিকার দেখা মিলল।
Advertisement
উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে গিয়ে ডানে মোড় নিতেই চোখ আটকে গেলে। বাসস্ট্যান্ড থেকে কয়েক কদম দূরেই মধ্যবয়সী দুই নারী ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। পুরুষে পুরুষে চোখ রাখছেন। অন্যজন মোবাইলের আয়নায় (স্কিন) চোখ রেখে ঠোঁটে লিপিস্টিক মাখছেন। এমন উত্তাপ ভরা পাকা সড়কে নারীদ্বয়ের দাঁড়িয়ে থাকা আর পরনের বসন দেখেই সোনাগাছি যৌনপল্লীর ঠিকানা ঠাহর করা গেল।
কাছে যেতেই সীমা নামের একজন মৃদুস্বরে আওয়াজ দিলেন। ‘বাবু চল যাই’। আর পাশের জন বললো, ‘বাবু, খাটে না চটে।’ ততক্ষণে ঘোর কাটলো। ফুটপাতে চায়ের দোকানেই তিনজনে মিলে খানিক আড্ডা। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর সটকে পড়তে চাইল দু’জনেই। বকশিশ দেয়ার কথা বলতেই দোলা নামের আরেকজন সময় দিতে রাজি হলেন।
দোলার বাড়ি বাংলাদেশ সীমানা হরিদাশপুর বোর্ডারের (বেনাপোল) কাছে। মায়ের হাত ধরেই কলকাতার এ রেড লাইট (নিষিদ্ধ পল্লী) এলাকায় পাড়ি জমান। সেই যে কৈশোরে পা দিয়েছেন, আজও বের হতে পারেননি। পল্লীতেই দু’বার বিয়ে করেছিলেন। দেহ ব্যবসার খাতিরেই বিয়ে। মা মারা যাওয়ার পর দোলা নিজেই ঘর ভাড়া করে ব্যবসা করছেন। ওর বাড়িতে এখন আটজন মেয়ে গতর খাটে।
Advertisement
পল্লীর নানা গলিতে হাঁটতে হাঁটতে ‘খাটে না চটে’-এর ব্যাখ্যা শোনালেন দোলা। যাদের কদর বেশি, দেখতে সুন্দর এবং বয়স কম তাদের নিয়ে ফূর্তি করাই মূলত ‘খাটে’ বোঝায়। আর যাদের বয়স বেশি, শরীরের গাঁথুনি ভেঙে পড়া, তাদের নিয়ে ফূর্তি করা বোঝায় মূলত ‘চটে’।
যৌনকর্মী দোলার সঙ্গ নেয়ায় অন্যরা আর টানাটানি করার ইচ্ছে পোষণ করলেন না। দোলা ১৯ বছর ধরে বাস করছেন এ পাড়ায়। পাড়ার সব খবরই ওর জানা। বলেন, এখানে কেউ আসে পেটের দায়ে। আবার কেউ আসে পাচার হয়ে। সুন্দরী, অল্প বয়সীরা পাচার হয়েই আসেন। আর পাচার হয়ে আসা নারীদের বেশির ভাগই আসেন পাশের দেশ বাংলাদেশ থেকে। তবে নেপাল, ভুটান আর পাহাড়ের মেয়েরাও আসে খপ্পরে পড়ে। পাচার হওয়ার পর থেকেই নানা হাত বদল হতে থাকে। পুলিশ, বিএসএফ-এর হাতও থাকে কখনও কখনও। আর বাকিরা দেহ খাটায় পারিবারিকভাবেই।
গল্পে গল্পে খানিক হাঁটার পর চোখে পড়লো শীতলা মায়ের মন্দির। একেবারে পল্লীর মধ্যখানে মন্দিরটি যেন আশ্রমের রূপ নিয়েছে। পুরনো, ঠাসা আর স্যাঁতস্যাঁতে গোছের বহুতল ভবনগুলোর ন্যায় মন্দিরটিও জীর্ণদশা প্রায়। তবে রোজ পুজা হয় বলে প্রাণে প্রাণে ভরপুর।
দুপুর বেলাতেও পুরোহিতের কাছ থেকে সেবা (অন্য) নিচ্ছেন যৌনকর্মীরা। আবার পল্লীর বাইরের অন্যরা এসেও ভোগের থালা সাজিয়ে পুজা দিচ্ছেন। পুজাতে মিলে যাচ্ছেন সবাই।
Advertisement
মন্দির থেকে কয়েক গলি পেরিয়ে দেখা মিলল সানাউল্লাহ গাজীর মাজার। সানাউল্লাহ গাজীর নামেই এ পল্লীর নামকরণ হয়েছে সোনাগাছি যৌনপল্লী। মন্দিরের ন্যায় মাজারটিও এ পল্লীর সবার। দান-খয়রাতেই চলে এ মাজার। মাজারে মানাত করেন হিন্দুরাও।
পল্লীর মন্দিরের কাছেই যৌনকর্মীদের বড় জটলা। দরকষাকষির মূল পয়েন্ট মূলত এখানেই। সরদার, মধ্যবয়সী, অল্প বয়সী সবাই শরীরের বিশেষ আবেদন তৈরি করে দাঁড়ায়ে এখানে। আর দালাল পুরুষরাও ঘিরে থাকে এদেরকেই। সবাই সবার চেনা। অথচ ব্যবসার খাতিরে সবাই যেন অচেনা। আর গলি পথে যারা দাঁড়িয়ে তাদের বেশির ভাগই অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী। সরদারের চোখে চোখেই তাদের দাঁড়িয়ে থাকা।
কথা হয়, হেমন্তী নামের আরেক যৌনকর্মীর সঙ্গে। বলেন, ব্যবসা আর আগের মতো নেই। এখন তো বাড়ি বাড়িতেই ব্যবসা চলে। কে আর আসে এখানে লোকচক্ষুর সামনে! মোবাইলে ডাকলেই তো হোটেল, বাড়িতে গিয়ে গতর খেটে আসে। এখন এ পাড়ায় হাহাকার বইছে। সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেও খদ্দের মেলে না। তবে যাদের শরীর আছে, তাদের কদর এখনও আছে। সুন্দরীদের বান্দা খদ্দেরের অভাব নেই।
এএসএস/জেএইচ/আরআইপি