মেয়ের কবর ছেড়ে বাড়ি ফিরতে চাচ্ছিলেন না কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের মা রাফেজা বেগম। নাওয়া-খাওয়া, ঘুম হারাম করে মঙ্গলবার সকাল থেকেই মেয়ের কবরের পাশে বসে ছিলেন তিনি। আর মেয়ের জন্য শুধু কান্না করে দোয়া পড়ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা তাকে বাসায় নেয়ার নানা চেষ্টা করলেও কোনোভাবেই তিনি মেয়ের কবর ছেড়ে যাচ্ছিলেন না। পরে দিন শেষে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাকে বাসায় নিতে সক্ষম হন পরিবারের সদস্যরা।
Advertisement
মঙ্গলবার বিকেলে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, পৃথুলার পরিবারের সদস্যরা কবর জিয়ারত করতে এসেছেন। সেখানে পৃথুলার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের। কথা হয় পৃথুলার মা রাফেজা বেগমের সঙ্গেও।
এই হতভাগা মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ডাক্তার বানাব। এ কারণে সায়েন্সে ভর্তি করিয়েছিলাম। কিন্তু ওর পাইলট হওয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল। প্রথমে আমি বাধা দিয়েছিলাম। পৃথুলার পাইলট হওয়ার ইচ্ছাটা অনেক বেশি হওয়ায় আমি আর বাধা দেইনি।’ এ কথা বলে কান্না করতে থাকেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘পৃথুলার জন্মদিন আগামী ১৮ জুলাই। জন্মদিন পালনে অনেক পরিকল্পনা নিয়েছিল সে। আত্মীয়-স্বজনদের আগেই দাওয়াত দিয়েছিল। অনেক ঘটা করে এ দিনটি পালন করার ইচ্ছা ছিল তার। জন্মদিনের পরের দিন বাবা-মাকে নিয়ে দেশের বাইরে বেড়াতে যাবে বলেছিল। কিন্তু উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় তার সব ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গেল।’
Advertisement
পৃথুলার এমন অসংখ্য স্মৃতিকথা মনে করে তার মা ও পরিবারের সদস্যরা এখন আর্তনাদ করে যাচ্ছেন। পৃথুলার আত্মার মাগফেরাত কামনা করতে শুক্রবার (২৩ মার্চ) বিভিন্ন মসজিদে দোয়া-মেনাজাতে আয়োজন করা হবে বলে পরিবারের সদস্যা জানিয়েছেন।
ঢাকায় মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পৃথুলাসহ পাঁচ নিহতকে দাফন করা হয়েছে। তারা হলেন, বিমান ক্রু শারমিন আক্তার নাবিলা, মো. নুরুজ্জামান, বিলকিস আরা, মো. রকিবুল ইসলাম। তারা সবাই মিরপুরের বাসিন্দা ছিলেন।
কবরস্থান ঘুরে দেখা গেছে, পৃথুলার কবরের চারপাশে বেড়া দেয়া হয়েছে। তবে এখনও নেমপ্লেট বসানো হয়নি। এছাড়া বিমান ক্রু শারমিন আক্তার নাবিলার কবরের ওপরে ঘাস দিয়ে সুন্দরভাবে ঢেকে দেয়া হয়েছে। অন্য কবরগুলো শুধু মাটি দিয়ে উঁচু করে রাখা হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা মঙ্গলবার সকাল থেকেই কবর জিয়ারত করে যান।
নিহত রকিবুলের কবর জিয়ারত করতে আসেন তার মামা মো. আবু তালেব ও তার পরিবারের সদস্যরা। এ সময় তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার আদরের ভাগ্নে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমরা কোনোভাবেই তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। সন্তানের নিহতের খবর শুনে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি সন্তানের জন্য শুধুই চোখের পানি ফেলে যাচ্ছেন। ’
Advertisement
এই দুর্ঘটনায় রকিবুলের স্ত্রী, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষক ইসমত কবির হাসির শ্বাসনালী ও ডান হাতের অনেকটা পুড়ে গেছে। তিনি এখন সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সোমবার (১৯ মার্চ) ২৩ নিহতের মরদেহ বাংলাদেশে আসার পর আর্মি স্টেডিয়াম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পরিবারের সদস্যদের কাছে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয়। সোমবার মরদেহগুলো নিয়ে বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি কার্গো বিমান।
যাদের মরদেহ আনা হয়েছে- আঁখি মনি, বেগম নুরুন্নাহার, শারমিন আক্তার নাবিলা, নাজিয়া আফরিন, এফএইচ প্রিয়ক, উম্মে সালমা, বিলকিস আরা, আখতারা বেগম, মো. রকিবুল হাসান, মো. হাসান ইমাম, মিনহাজ বিন নাসির, তামারা প্রিয়ন্ময়ী, মো. মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহারা তানভীন শশী রেজা, অনিরুদ্ধ জামান, রফিক উজ জামান, পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ, খাজা সাইফুল্লাহ, ফয়সাল, সানজিদা ও নুরুজ্জামান।
গত ১২ মার্চ (সোমবার) ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস-২১১ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ৬৭ যাত্রী ও চার ক্রুসহ দুপুর ২টা ২০ মিনিটে বিমানটি বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এতে ৫১ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ১০ বাংলাদেশি আহত হন। আহতদের উদ্ধার করে প্রথমে নেপালের বিভিন্ন হাসপাতলে ভর্তি করা হয়। এরপর আহত সাত বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত আনা হয়। সর্বশেষ সোমবার আহত কবীর হোসেনকে দেশে আনা হয়। রোববার দেশে ফিরিয়ে আনা হয় আহত শাহিন বেপারীকে। এর আগে শেহরিন আহমেদ, কামরুন্নাহার স্বর্ণা, মেহেদী হাসান, আলমুন্নাহার অ্যানি ও রাশেদ রুবায়েত দেশে ফেরেন। তারা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
বিমানটিতে মোট ৬৭ যাত্রীর মধ্যে বাংলাদেশি ৩২ জন, নেপালি ৩৩ জন, একজন মালদ্বীপের ও একজন চীনের নাগরিক ছিলেন। তাদের মধ্যে পুরুষ যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৭, নারী ২৮ ও দুজন শিশু ছিল।
এমএইচএম/জেডএ/এমএস